মামার একমাত্র মেয়ে লায়লা ছিল আমারই বয়সী। তাই আমার প্রতিটা দুষ্টুমিতে আমার সঙ্গী হত। বিভিন্ন গাছের ফল চুরি, শীতকালে খেজুরের রস চুরি, সমবয়সী ছেলে-মেয়েদের সাথে মারামারি ছিল আমাদের নিত্যদিনের কাজ। আমি পড়াশোনায় বেশ ভাল ছিলাম। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু স্কুলেও আমার দুষ্টুমিতে সবাই অতিষ্ঠ ছিল। নানা কারণে প্রতিদিন লোকে মামা-মামীর কাছে নালিশ নিয়ে আসত। কিন্তু মামা-মামী আমাকে কখনও বকতেন না। তাঁদের অতিরিক্ত আদর পেয়ে আমি যেন আস্ত একটা বাঁদর হয়ে উঠলাম।
আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমি আর লায়লা ঠিক করলাম সোবহান কাকাদের খেজুর গাছের রস চুরি করব। কিন্তু ওই সময় আমি বড় হচ্ছি, আগের মত বাচ্চা নেই। তাই যখন-তখন বাসা থেকে বের হওয়া আমার জন্য নিষেধ ছিল। বুঝতে পারলাম, কাজটা করতে হবে অতি গোপনে। তা ছাড়া, সোবহান কাকা ছিলেন বদরাগী ধরনের মানুষ। তিনি আমাদের ধরতে পারলে কপালে দুঃখ আছে।
রাত দশটায় লায়লার আর আমার বের হওয়ার কথা। কিন্তু ওই সময় হঠাৎ লায়লা বলল, ওর ভয় লাগছে। ও আজ যাবে না। আমাকেও যেতে নিষেধ করল।
আমি বুঝতে পারলাম, ওর ঘুম পাচ্ছে। তাই অজুহাত দিচ্ছে। আমি রাগত গলায় বললাম, ‘তুই না গেলে আমি কিন্তু একাই যাব।’
লায়লা হাই তুলতে-তুলতে বলল, ‘সাহস থাকলে একা যা।’
লায়লা জানে রাতে একা রস চুরি করার মত দুঃসাহস আমার হবে না। কিন্তু আমার জেদ চেপে গেল। তাই একা-একাই বেরিয়ে পড়লাম। অন্ধকার রাত। পোকা-মাকড় শব্দ করছে একটানা। আমি বারবার চমকে উঠছি আর পিছনে তাকাচ্ছি। বারবার মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার পিছনে-পিছনে আসছে।
সোবহান কাকাদের অনেকগুলো খেজুর গাছ। আমি খুব ভাল গাছে চড়তে পারি। রস খাওয়ার ইচ্ছা তেমন একটা ছিল না। কিন্তু রস চুরি করে লায়লাকে বীরত্ব দেখানোর ইচ্ছাটা পেয়ে বসেছিল।
আমি একটা গাছে উঠতে শুরু করলাম। উঁচু গাছ। উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কিছুদূর ওঠার পর আমার মনে হলো, আশপাশের পরিবেশ হঠাৎ অস্বাভাবিক রকম শান্ত হয়ে গেল। নীচে নেমে যাব কি না ভাবছিলাম, কিন্তু একটু অপেক্ষা করে আবার উপরে উঠতে শুরু করলাম। এমন সময় হঠাৎই দেখতে পেলাম, আমার ঠিক মাথার উপরে একজন মানুষ। সে উল্টোভাবে গাছে ঝুলে আছে। তার গায়ে কোনও কাপড় ছিল না। দেখলাম তার সারা শরীরে অসংখ্য ছোট-ছোট গর্ত। সেই গর্তে সাদা-সাদা পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে পোকাগুলো যেন লোকটার শরীরে বাসা বানিয়ে নিয়েছে। তার চোখ নেই। চোখের কোটরও পোকায় পরিপূর্ণ। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হাসল। মুখের মধ্যেও পোকা ভর্তি অনেকগুলো ছোট-ছোট গর্ত দেখতে পেলাম। লোকটা হিসহিসে গলায় বলল, ‘রস খাবা?
আমি মৃগী রোগীর মত কাঁপতে লাগলাম। একসময় বুঝতে পারলাম, নীচে পড়ে যাচ্ছি। কয়েক মুহূর্তেই নীচে পড়ে জ্ঞান হারালাম। শব্দ আর চিৎকার শুনে সোবহান কাকাদের ঘর থেকে অনেকেই বের হলো। তারা আমাকে মামার বাসায় নিয়ে গেল। বেশ উপর থেকে পড়ার পরেও আমার শরীরে আঘাত খুব বেশি লাগেনি।
মাথায় পানি ঢালা হলো। একসময় আমার জ্ঞান ফিরল। কিন্তু সেটা পূর্ণ জ্ঞান ফেরা নয়। ধীরে-ধীরে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। আশপাশের সবকিছু কেমন যেন ছায়া-ছায়া মনে হচ্ছিল।
প্রচণ্ড জ্বর এল আমার। যাকে বলে আকাশ-পাতাল জ্বর। মামা-মামী গ্রামের ডাক্তার-কবিরাজ কোনোটাই বাদ রাখলেন না। কিন্তু আমার জ্বর কমল না। আমাকে শহরের হাসপাতালেও নেয়া হলো। সেখানে অনেক পরীক্ষা করেও ডাক্তাররা কোনও রোগ খুঁজে পেলেন না। তিন দিন পর আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হলো। এর মধ্যে আমি অনেকবারই ওই লোকটাকে দেখতে পেয়েছি। এমনকী তার শরীরের পোকাগুলোও স্পষ্ট দেখেছি। লোকটাকে দেখলেই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আর জ্ঞান হারালেই আমার মুখ দিয়ে বেরোতে থাকে ফেনা।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর অনেকেই বলল, আমার উপর নাকি জিনের আছর হয়েছে। আমাকে তাই লোকমান ফকিরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। লোকমান ফকির সুফি ধরনের মানুষ। সারাদিন ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে থাকেন। সবাই তাঁকে পবিত্র মানুষ মনে করে। তিনি নাকি মানুষের চোখ দেখে অনেক কিছু বলে দিতে পারেন। আমাদের গ্রামসহ আশপাশের অনেক গ্রামে তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল। তাঁর নাকি জিন সাধনাও আছে।
আশপাশের পাঁচ-দশ গ্রামে কাউকে জিনে ধরলে একমাত্র ভরসা লোকমান ফকির। তিনি কোরআনে হাফেজ। কিন্তু নামের প্রথমে কখনও হাফেজ টাইটেল ব্যবহার করেন না। তাঁর তিন কুলে কেউ নেই। অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন। সেই স্ত্রী বিয়ের এক বছরের মাথায় কলেরায় মারা যায়। এরপর আর বিয়ে করেননি। বাড়িতে একা-একাই থাকেন। তাঁর বাড়ি নিয়ে গ্রামে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। খুব দরকার না পড়লে কেউ ওই বাড়িতে যেতে চায় না।
লোকমান ফকির কোনও শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসা করেন না। শুধুমাত্র জিনে ধরা রোগীদেরই চিকিৎসা করেন। এর বিনিময়ে অল্পবিস্তর হাদিয়াও গ্রহণ করেন। তবে কেউ কিছু না দিলে কখনও আপত্তি করেন না।
আমাকে দেখলেন লোকমান ফকির। দেখে তাঁর মুখ কালো হয়ে গেল। আমার কপালে হাত রাখলেন। মুখে বিষাদের ছায়া পড়ল।