ঠাণ্ডা চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে আবারও বলল আনোয়ার, ‘পিশাচের মাধ্যমে সোলেমান গাজি জানতে পেরেছেন, যদি জয়ের কোনও সন্তান পৃথিবীতে আসে, তবে সে হবে প্রবল ক্ষমতাশালী। সে জয়ের সন্তান হবে না, হবে পিশাচের সন্তান। ইচ্ছা হলে সেই সন্তান সব ধ্বংস করে দিতে পারবে, আবার সব গড়তেও পারবে, পৃথিবীকে আনতে পারবে হাতের মুঠোয়। সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তাঁরা নুযহাতকে বেছে নেন।’
চুপ করে শুনছেন রফিক সাদি। তাঁর দিকে চেয়ে আনোয়ার বলল, ‘আমরা ঝমঝম কুঠিতে প্রতিটা মানুষের গায়ে যে উল্কি দেখেছি, সেটা কার অবয়ব, এখন বুঝতে পারছেন?’
রফিক সাদি কাঁপা গলায় বললেন, ‘জয়ের?’
আনোয়ার একটু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ওটা জয়ের অবয়ব।’
‘কিন্তু জয়কে আমার অফিসে দেখলাম স্বাভাবিক আর এলেমদারিতে দেখলাম অপ্রকৃতিস্থ। কারণটা কী?’
‘পিশাচটা যখন ঘুমিয়ে থাকে বা বিশ্রাম নেয়, তখন আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতই আচরণ করে জয়। কিন্তু যখন পিশাচটা সক্রিয় থাকে, তখন জয় প্রতিবন্ধীর মত আচরণ করতে থাকে।’
‘তা হলে এলেমদারির সব লোকই পিশাচের উপাসক?’
‘হ্যাঁ। এরা এলেমদারি বনে বাস করলেও কর্মসূত্রে পুরো ঢাকা শহরে ছড়িয়ে আছে। এদের কেউ ক্লিনিকে কাজ করে, কেউ অফিসে করে, কেউ দোকানের কর্মচারী। পাশাপাশি এরা শিকারের খোঁজ রাখে। বিভিন্ন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে, তারপর এলেমদারি বনে নিয়ে যায়। সবসময় যে তারা সফল হয়, তা নয়, তবে চেষ্টা চলতে থাকে। আপনি ফারহানা নামে যে মেয়েটাকে ঝমঝম কুঠিতে দেখেছিলেন, তার নীরব নামে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। নীরবই তাকে এলেমদারি বনে নিয়ে যায়। আর বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, জয়ই কখনও নীরব, কখনও আসিফ, কখনও রফিক হয়ে নানা মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।’
‘ফারহানা মেয়েটার কী অবস্থা এখন?’ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন রফিক সাদি।
‘আগামীকাল তাকে পিশাচের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হবে। এটা হবে সোলেমান গাজির আটত্রিশতম শিকার। আটত্রিশতম উৎসর্গ সোলেমান গাজির পিশাচ সাধনাকে পরিপূর্ণতা দেবে। কালকের পরেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতা আর সম্পদ পেয়ে যাবেন তিনি। জয়ের সন্তানকে নিয়ে তিনি পুরো পৃথিবীতে রাজত্ব করতে চান।’
রফিক সাদি ভাঙা গলায় বললেন, ‘আমার মেয়ে তো জয়ের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে, তা হলে ওটা কি পিশাচের সন্তান?’
‘হ্যাঁ, ওটা পিশাচ এবং নুযহাতের সন্তান।’
‘এখন আমরা কী করব?’
‘সোলেমান গাজিকে সফল হতে দেয়া যাবে না। কালকে রাতে যদি আটত্রিশতম উৎসর্গ করতে পারেন, তা হলে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন তিনি। তাঁকে ধরার মত সব প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। আমি প্রস্তুত, পুলিশও প্রস্তুত।’
‘তোমার পরিকল্পনা কী?’
‘কালকে পিশাচটাকে রাগিয়ে দিলে সে সর্বনাশ করবে জয়, সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রীর। এতদিনের সাধনা একদিনেই শেষ হয়ে যেতে পারে। পিশাচ প্ৰথমে এই তিনজনের প্রাণ নেবে। তারপর চিরদিনের মত চলে যাবে। আর আগে থেকেই পুলিশ এলেমদারি বনের বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত থাকবে, সময়মত সবাইকে গ্রেফতার করবে তারা।’
‘আমার মেয়েটা কি মারা যাবে, বাবা?’ প্রায় কেঁদে ফেললেন রফিক সাদি।
‘আপনি শান্ত হোন। চিন্তা করবেন না। আশা করি, নুযহাত আর ফারহানাকে আমরা বাঁচাতে পারব। আর নুযহাতকে তো ওঁরা কোনওভাবেই মারবেন না। কারণ, নুযহাতের গর্ভে জয়ের সন্তান। জয় নুযহাতকে নানাভাবে সম্মোহিত করেছে। ওর হাতে যে তাবিজ আছে, সেগুলো যেভাবে হোক সরাতে হবে। তাবিজের মাধ্যমেই জয় নুযহাতকে নানা নির্দেশনা পাঠাত।’
নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে রফিক সাদি বললেন, ‘তুমি এত কিছু কীভাবে জানলে?’
‘পিশাচ সাধনা বিষয়ে আমার আগে থেকেই ধারণা রয়েছে। প্রচুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও ছিল। আর সোলেমান গাজির কাছের সহযোগী ইদ্রিসকে আমরা ধরতে পেরেছি। তার মাধ্যমে আমরা প্রচুর তথ্য পেয়েছি। সোলেমান গাজি যে সাঁইত্রিশজন মেয়েকে হত্যা করেছে, তাদের পরিচয়ও জানতে পেরেছি। বাড়ির পিছনের কবরস্থানে কবর দেয়া হয়েছিল তাদেরকে। আপনাকে এই ধরনের অন্য একটা ঘটনা বলি। উনিশ শ’ সাতানব্বুই সালে ইন্দোনেশিয়ায় পুলিশ আহমাদ সুবাদজি নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। সেই লোকও পিশাচ সাধক ছিল। বিভিন্ন নারীকে ধরে ইলেকট্রিক তার পেঁচিয়ে হত্যা করত। এরপর পান করত তাদের লালা। এরপর বাড়ির সামনেই কবর দিত লাশগুলোর। তবে আসলেই পিশাচ তার ওপর ভর করেছিল কি না, সে ব্যাপারে অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি পরবর্তীতে ইন্দোনেশিয়ার আদালত লোকটাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আসলে সোলেমান গাজির মত এমন ভয়ঙ্কর লোক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।’
‘আমি আর এসব কিছু শুনতে চাই না, আমার মেয়েকে তুমি বাঁচাও।’
‘আপনাকে এবং ড্রাইভার মহসিনকে কালকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। মহসিন এলেমদারি বনের বাইরে থাকবে। আপনি আর আমি ভেতরে যাব। আপনি সুযোগ বুঝে ফারহানা আর নুযহাতকে নিয়ে পালাবেন। এরপর সোজা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন।’
‘আর তুমি?’
‘প্রথমে নিজে, এরপর আমার বন্ধু শাহেদকে নিয়ে বাকিটা সামলাব। চিন্তার কিছু নেই।’