ইদ্রিসের শরীরেও সেই একই উল্কি আঁকা।
ইদ্রিসকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে শুরু করল আনোয়ার আর শাহেদ। প্রথমে মুখ না খুললেও পরে মুখ খুলতে বাধ্য হলো ইদ্রিস। ঘোলাটে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে উঠল আনোয়ার ও শাহেদের কাছে। ইদ্রিসকে নিয়ে থানার দিকে রওয়ানা হলো শাহেদ ও আনোয়ার। আরও অনেক কিছু জানার আছে তাদের। ইদ্রিসের সাহায্য দরকার।
এগারো
দুই দিন পর…
বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন রফিক সাদি। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। নিজেকে এত অসহায় আগে কখনও লাগেনি। তাঁর মেয়ে ঝমঝম কুঠিতে বউ হয়ে গেছে, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? একটু আগে নুযহাত ফোন করেছিল। নেটওয়ার্কের জন্য কথা ভাল শোনা যাচ্ছিল না। শুধু রফিক সাদি এটুকুই বুঝলেন, নুযহাত বলছে-ভাল আছে সে। নুযহাতের এ কথা তাঁকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। তিনি কিছু খেতে পারছেন না, মাথায় কেন জানি অসহ্য ব্যথা।
ঠিক এসময় রফিক সাদিকে জানানো হলো, তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন আনোয়ার নামে একজন।
মনে-মনে এই ছেলেটিকেই খুঁজছিলেন তিনি। দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন।
ড্রয়িং রুমে রফিক সাদিকে দেখে হাসল আনোয়ার।
ছেলেটার হাসিটা খুব সুন্দর, ভাবলেন রফিক সাদি। ওই হাসি মনের ভিতর কেমন যেন একটু প্রশান্তি এনে দিল।
আনোয়ার বলল, ‘কেমন আছেন?’
সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে রফিক সাদি বললেন, ‘আমার মেয়ে ঝমঝম কুঠিতে চলে গেছে। এই চিঠিটা রেখে গেছে।’
আনোয়ার একটু চমকে উঠল।
চিঠিটা পড়ে ঢিপঢিপ করতে থাকল বুকের ভিতরটা, কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করল না। মুখ স্বাভাবিক রেখে আনোয়ার বলল, ‘আমি জানি, সবকিছু মিলিয়ে আপনার মনে অনেক প্রশ্ন জমে গেছে। আপনার সব প্রশ্নের জবাব দিতেই এসেছি।’
‘চলো, চা খেতে-খেতে কথা বলি।’
চা এল মাত্র তিন মিনিট পর।
চায়ে চুমুক দিয়ে আনোয়ার বলল, ‘বিষয়টা একটু জটিল। কোথা থেকে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না। যা হোক, সোলেমান গাজির বাবা ইব্রাহিম গাজিকে দিয়েই শুরু করি। ইব্রাহিম গাজি একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষ ছিলেন। পিশাচ সাধনার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। মধ্যবয়সে এক তান্ত্রিকের কথা অনুসারে পিশাচ সাধনা শুরু করেন। এই সাধনার একটাই লক্ষ্য, পিশাচকে কাজে লাগিয়ে অভাবনীয় শক্তি অর্জন করা। ইব্রাহিম গাজি পিশাচকে নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। সেসময় তিনি দূর-দূরান্ত থেকে মেয়েদেরকে ধরে আনতেন। শারীরিক নির্যাতনের পর, পিশাচের উদ্দেশে বলি দিতেন তাদেরকে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি ইব্রাহিম গাজি। তখন তিনি অন্য পথ বেছে নিলেন। নিজের ছেলের মধ্যে পিশাচকে প্রবেশ করাতে চাইলেন। যৌবনে ছেলে সোলেমান গাজির মধ্যেও সাধনার বিষয়টা ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু সোলেমান গাজিকেও পছন্দ করেনি পিশাচ। একসময় ইব্রাহিম গাজি মারা গেলেন। প্রবল উৎসাহে সাধনা চালিয়ে যেতে লাগলেন সোলেমান গাজি। আরও কয়েকজনকে খুঁজে বের করলেন, যারা সবাই এ অন্ধকার পথের বাসিন্দা। তাদেরকে জায়গা দিলেন এলেমদারি বনে। সোলেমান গাজির স্ত্রীও এক পিশাচ সাধক। তাই দু’জনে জমল ভাল। সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁদের সন্তানের জন্মের সাথে- সাথে তাকে পিশাচের উদ্দেশে বলি দেবেন। এত বড় উপহার পেয়ে পিশাচ নিশ্চয় তাঁদের কারও মধ্যে প্রবেশ করবে। জয়ের জন্মের কিছুদিন আগেই হঠাৎ সোলেমান গাজির স্বপ্নে দেখা দিল পিশাচ। সে জানাল, তাঁদের অনাগত সন্তানকে বলি দেয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। সন্তানের বয়স যখন একুশ হবে, তখন পিশাচ তার মধ্যে প্রবেশ করবে। সোলেমান গাজির এতদিনের সাধনা যেন ঠিকানা খুঁজে পেল। পিশাচটা আরও জানাল, সে যখন জয়ের মধ্যে প্রবেশ করবে, তখন থেকে নিয়মিত তার রক্ত ও বলি চাই। এর বিনিময়ে সোলেমান গাজিকে পিশাচটা দেবে অভাবনীয় ক্ষমতা ও সম্পদ। তবে চূড়ান্ত সম্পদ আর ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তাঁকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। জয়ের বয়স যখন একুশ, তখন ওর শরীরে প্রবেশ করল পিশাচটা। পিশাচ একবার কারও শরীরে প্রবেশ করলে সেই শরীরটা তার হয়ে যায়। তাই জয়ই পিশাচ, পিশাচই জয়। এরপর থেকে সোলেমান গাজিকে আরও বেশি সচেতন থাকতে হলো। কারণ, পিশাচকে কোনওভাবেই রাগিয়ে দেয়া চলবে না। সে রাগলে, অনর্থক জীবনহানি হবে। একে নিয়ন্ত্রণ করা কোনও সহজ বিষয় নয়। এর প্রধান খাদ্য রক্ত। আর নারীকে উৎসর্গ করলে মিলবে এর সন্তুষ্টি। সোলেমান গাজি নিয়মিত বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত আনা শুরু করলেন। ক্লিনিকের অসৎ কর্মচারীরা এ কাজে সাহায্য করত। প্রতি সাত দিন অন্তর পিশাচের তিন ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হত। দু’ব্যাগ সে পান করত, আর এক ব্যাগ দিয়ে গোসল করানো হত তাকে। আর সাতচল্লিশ, ছাপান্ন বা পঁয়ষট্টি দিন অন্তর কোনও যুবতী মেয়েকে তার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হত। এক সংখ্যাটা পিশাচের জন্য শুভ। কারণ, একের সাথে শনির একটা যোগাযোগ রয়েছে। সাতচল্লিশ সংখ্যাটির দুই অঙ্ক যোগ করলে যোগফল পাওয়া যায় এগারো, অর্থাৎ দুটো এক। ছাপান্ন এবং পঁয়ষট্টির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার, যোগফল এগারো।’
একটু থেমে আনোয়ার আবার বলল, ‘নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যদি কোনও যুবতী মেয়েকে পিশাচের জন্য উৎসর্গ না করা হয়, তবে সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রীর পরিণতি হবে ভয়াবহ। কারণ, তাঁদের আহ্বানেই পিশাচটা এসেছে। সোলেমান গাজি চতুর মানুষ, হিসাবে ভুল করেননি। অনুসারীদের এবং জয়কে এই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। এরা বিভিন্ন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তারপর ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঝমঝম কুঠিতে নিয়ে এসেছে। ঝমঝম কুঠিতে আনার পর এক পর্যায়ে মেয়েগুলোর মাথা কেটে ফেলা হত। তার আগে শরীরে আঁকা হত উল্কি, আর নিয়মিত খাওয়ানো হত ভাঙের শরবত। এরপর সময়মত পিশাচের উদ্দেশে উৎসর্গ করত। উৎসর্গ প্রক্রিয়াটা বেশ অদ্ভুত। প্রথমে খোলা মাঠের মধ্যে মেয়েটাকে হাঁটু গেড়ে বসানো হত। তার ঠিক সামনে থাকত জয়, যার মধ্যে রয়েছে পিশাচটা। এরপর গলায় ইলেকট্রিক তার পেঁচিয়ে, শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলা হত মেয়েটাকে। কয়েকজন তাকে চেপে ধরত, আর একজন একটা ছোট পাত্রে তার মুখের লালা সংগ্রহ করত। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর সেই লালা জয় বা পিশাচকে দেয়া হত। আনন্দ নিয়ে এই লালা পান করত পিশাচ। এতে আরও বাড়ত তার শক্তি। এরপর মেয়েটির মৃতদেহ জয়ের পায়ের কাছে রেখে গলায় সজোরে ছুরি চালানো হত। রক্তে ভিজে যেত জয়ের পা। এতে সন্তুষ্টি বাড়ত পিশাচের। এলেমদারি জঙ্গলের কিছু জায়গায় মোগল যুগের কিছু দামি রত্ন রয়েছে। পিশাচের মাধ্যমে সেগুলো কোথায় জানতে পেরেছেন সোলেমান গাজি। ফলে দু’হাতে আসতে লাগল টাকা। সে টাকার ভাগ তিনি এলেমদারির অন্যান্য লোকদেরও দিয়েছেন।’