রফিক সাদি মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন।
তাঁর পিছু নিল কয়েকজন।
পিছনে না তাকিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, তিনি রীতিমত দৌড়াচ্ছেন। একসময় বন পেরিয়ে চলে এলেন মূল রাস্তায়। পিছনে চেয়ে কাউকে আর দেখতে পেলেন না।
ছয়
রফিক সাদিকে হাঁপাতে দেখে পানি নিয়ে ছুটে এল মহসিন।
এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করলেন সাদি।
মহসিন চিন্তিত গলায় বলল, ‘ভাই, কোনও সমস্যা? প্রায় আধঘণ্টা ধরে আপনার মোবাইলে চেষ্টা করছি, কিন্তু ঠিকমত নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘কোনও সমস্যা নেই,’ নিজেকে শান্ত করে বললেন রফিক সাদি। একটু বিরতি দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘তা, তুমি আমাকে ফোন করছিলে কেন?’
‘ইয়ে…মানে…ভাই, আপনি এলেমদারি বনে যাওয়ার পর আমি হাইওয়ে ধরে খানিকটা সামনে গিয়েছিলাম। মাইল খানেক দূরে কয়েকটা চায়ের দোকান পেলাম। ওখানে বসে চা খাচ্ছিলাম। চায়ের দোকানদারের সাথে কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ এলেমদারি বনের কথা উঠল। আমার কথায় যেন চমকে গেল লোকটা। বলল যে, এই বন নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক কথা। কী প্রচলিত আছে তা কেউ বলতে চাইল না। তবে আকার-ইঙ্গিতে মনে হলো, অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়েছে এই বনে। ঝমঝম কুঠিতে নাকি ভূত থাকে, এটাও মুখ ফসকে বলে ফেলল একজন। আমি এসব শুনে আর দেরি করিনি, গাড়ি নিয়ে দ্রুত এলেমদারি বনের সামনে এসে আপনাকে ফোন করেছি। আপনাকে যখন ফোনে পাচ্ছিলাম না, তখন কাঁপতে লাগল বুক।’
‘মহসিন, বুক তো আমারও কাঁপছে। তবে নিজের জন্য যত না, তার চেয়ে বেশি আমার মেয়ের জন্য।’
‘ভাই, আমাকে বলবেন কী হয়েছে?’
খানিক ভেবে রফিক সাদি বললেন, ‘হ্যাঁ, বলব।’
রফিক সাদি সব খুলে বললেন মহসিনকে।
নুযহাতের অদ্ভুত আচরণ, এলেমদারি বন এবং ঝমঝম কুঠির আজব সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন।
মহসিন বলল, ‘ভাই, এদের তো স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।’
‘হ্যাঁ, আমারও তা-ই ধারণা, কিন্তু কী করব বুঝতে পারছি না। নুযহাত আমার কথা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।’
‘আমি একজন মানুষকে চিনি, পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে কিছু লেখাও পড়েছি। কেন জানি মনে হচ্ছে, তিনি এই সমস্যার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন। তাঁর কাছে একবার যাবেন নাকি?’
‘কী ধরনের সাহায্য?’
‘উনি ভৌতিক এবং রহস্যের বিষয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ। মানুষকে এসব ব্যাপারে সাহায্য করেন।’
‘তাঁর নাম?’
‘আনোয়ার।’
‘তুমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চেনো?’
‘আমাদের গ্রামে একবার গিয়েছিলেন। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সাথে। আমাদের গ্রামে শিগব নামে এক অপদেবতার উপদ্রব হয়েছিল, উনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে রক্ষা করেছিলেন।’
‘চলো, তা হলে তাঁর কাছে যাই। এতদিন এই বিষয়গুলো বিশ্বাস করিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিশ্বাস করতেই হবে।’
সাত
আনোয়ারদের ছাদের চিলেকোঠায় বসে আছেন রফিক সাদি ও মহসিন। আনোয়ারের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। কয়েকটা পত্রিকায় তাকে নিয়ে ফিচার হয়েছে। এরপর থেকেই বাসায় মানুষজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। অনেকেই বিচিত্র সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসছে। কিন্তু সে তো বেশিরভাগ সমস্যারই সমাধান দিতে ব্যর্থ। আর তার মূল কাজ রহস্য বা ভয়ের পিছনে ছোটা, মানুষকে সাহায্য করা নয়।
মহসিনকে চিনতে পেরেছে আনোয়ার। পাতাকাটা গ্রামে লোকটির সাথে দেখা হয়েছিল।
রফিক সাদির সাথে আনোয়ারের পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর রফিক সাদি পুরো ঘটনাটা আনোয়ারকে বললেন।
মন দিয়ে শুনল আনোয়ার। কথার শেষে বেশ কয়েকটা প্রশ্নও করল।
‘আচ্ছা, আপনি তো বললেন নুযহাতের হাতে তাবিজের মত কিছু জিনিস দেখতে পেয়েছেন। জয়ের হাতে বা শরীরের কোথাও কি এমন কিছু দেখেছিলেন?’
চমকে উঠলেন রফিক সাদি। আরে, তাই তো! জয়ের হাতেও কয়েকটা তাবিজ বাঁধা ছিল। জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। তার হাতেও ছিল।’
‘আপনি বলছিলেন এলেমদারি বনে যারা বাস করে, সবার শরীরে এক ধরনের উল্কি আঁকা এবং উল্কিটা মানুষের অবয়বের। ভেবে দেখুন তো, আপনার পরিচিত কোনও মানুষের সাথে অবয়বটার মিল আছে?’
‘আমার বারবার মনে হচ্ছিল অবয়বটা আমি চিনি। কিন্তু ….’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, পরে কিছু মনে পড়লে আমাকে তা জানাবেন। আমার মোবাইল নাম্বার রেখে দিন। আর আপনার মেয়ের বিয়ের চিন্তা আপাতত বাদ রাখুন।’
‘মেয়েটা তো বিয়ে নিয়ে কেমন পাগলের মত করছে।’
‘তাকে বোঝান, একটু ধৈর্য ধরতে বলুন। আর শুরুতেই এলেমদারির লোক খারাপ বা ভাল, এসব ভাববেন না। মানুষের কথায় কান দেবেন না। আমি নিজে জায়গাটায় যাব। আশা করছি, দেরি না করেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আপনাকে জানাতে পারব।’
‘ঠিক আছে। তবে আপনার ওখানে যাওয়াটা একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে না?’
‘চিন্তা করবেন না। আমি নির্বোধ নই, নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেই যাব। আপনিও আমার সাথে যাবেন।’ একটু থেমে আনোয়ার বলল, ‘ও, আরেকটা কথা, আপনি বলছিলেন ওখানে একটা মেয়েকে দেখেছেন। তার নাম জানতে পেরেছেন বা অন্য কিছু?’
‘না, আমি ওই সময়ে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, তাই এসব জিজ্ঞেস করার কথা মাথায় আসেনি। তবে…’
‘তবে কী?’
‘সম্ভবত মেয়েটার একটা আইডি কার্ড আমি আনতে পেরেছি।’
‘গুড, কোথায় সেই আইডি কার্ড?’