জয়ের বাবা বললেন, ‘আমি সোলেমান গাজি। জয়নাল আপনার কথা আমাদের বলেছে।’
‘জয়নাল কে?’
‘জয়ই জয়নাল। আপনাদের কাছে জয়, আমাদের কাছে জয়নাল। হা-হা।’ সোলেমান গাজির হাসিটা যেন কেমন, পুরো শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
‘আচ্ছা, আচ্ছা। আসলে ছেলে-মেয়ে দু’জন দু’জনকে পছন্দ করেছে, এখন বাবা-মা হিসাবে আমাদের দায়িত্ব ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করা।’
‘দেন, বিয়ে দেন,’ কান চুলকাতে চুলকাতে বললেন সোলেমান গাজি।
‘হ্যাঁ, বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার জন্যই আসলে আমি এসেছি।’
‘দিন-তারিখ ঠিক করতে হবে না, আপনি একদিন মেয়েকে নিয়ে আসুন। সেদিনই বিয়ে হয়ে যাবে।’
‘আমি মেয়ে এখানে এনে বিয়ে দেব?’ রফিক সাদির বিস্ময় যেন সব সীমা অতিক্রম করল।
এবার জয়ের মা বললেন, ‘হ্যাঁ। আমরা বাইরে তেমন বের হই না। বিয়ে সংক্রান্ত এত ঝামেলা আমাদের পছন্দ নয়। আপনি মেয়ে সাজিয়ে এখানে নিয়ে আসবেন, বিয়ে হবে। তারপর থেকে মেয়ে আমাদের।’ আমাদের কথাটার উপর তিনি অনাবশ্যক জোর দিলেন।
রফিক সাদি কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। ক্রমেই খারাপ হচ্ছে মেজাজ। এঁরা কি নির্বোধ?
এমন সময় হেলতে-দুলতে কেউ ঘরে ঢুকল। রফিক সাদি তাকিয়ে দেখলেন-জয়। জয়ের দিকে তিনি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মাথায় কোনও চুল নেই। গলা থেকে পেট পর্যন্ত উল্কি আঁকা। তবে একটা মানুষের অবয়বের পাশাপাশি শরীরে কিছু দুর্বোধ্য অক্ষর। জয়ের জিভ বের করা, মুখ থেকে লালা পড়ছে। বোকার মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।
জয়ের বাবা বিরক্তমুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই এখানে কেন?’ জয় কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলল, ‘ব্যথা করে। খুব ব্যথা করে। ছোট বাচ্চা যেমন কান্নার আগে ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলে, জয়ও তেমন ভঙ্গি করল।
সোলেমান গাজি ধমক দিয়ে বললেন, ‘খবরদার, কাঁদবি না। বজ্জাত।’
জয় বাবার ধমক শুনে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগল।
জয়ের মা-ও ধমকে উঠলেন, ‘যা এখান থেকে!’
চোখ মুছতে-মুছতে চলে গেল জয়।
এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের বিব্রত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু তাঁদের মুখে কোনও অস্বস্তির ছাপ দেখা গেল না। জয়ের মা নিরস গলায় বললেন, ‘মাঝে- মাঝে ছেলেটা কেমন যেন ছোট হয়ে যায়। পাগল-ছাগলের মত আচরণ করে।’ বলতে-বলতে তিনি হাসলেন। যেন ছেলে পাগল-ছাগল হওয়াতে তিনি মহাখুশি।
এমন সময় জয়ের চিৎকার করে কান্নার শব্দ শোনা গেল।
সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রী প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন।
রফিক সাদির মনে কেমন যেন অজানা ভয় কাজ করছে।
এসব কী হচ্ছে!
তিনি ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালেন।
সোলেমান গাজির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎ রফিক সাদির সামনে এসে দাঁড়াল এক মেয়ে। আশ্চর্যের বিষয় মেয়েটার মাথায়ও কোনও চুল নেই। মুখে-গলায় ছোপ ছোপ রক্ত। কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে বাঁচান!’
রফিক সাদি বললেন, ‘মানে? কে তুমি?’
ভাঙা গলায় কাতর সুরে বলল মেয়েটি, ‘আমাকে মেরে ফেলবে! সত্যি আমাকে মেরে ফেলবে! আমাকে বাঁচান!’
‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’
মেয়েটা হাতজোড় করে বলল, ‘আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। আমি আপনাকে পরে সব বুঝিয়ে বলব। চলুন।’
রফিক সাদি হতবুদ্ধির মত তাকিয়ে রইলেন।
এই মেয়ে পাগল নাকি? কেমন উদ্ভট কালো জোব্বা আকৃতির পোশাক পরে আছে। মুখ দিয়ে আসছে বিশ্রী গন্ধ। মনে হচ্ছে মদ জাতীয় কিছু খেয়েছে। কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগের চেন খোলা। এমন সময় সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রী ঘরে ঢুকে মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠলেন। ‘তুই? তুই ঘর থেকে বের হয়েছিস? যা! ঘরে যা!’
মেয়েটা চিৎকার করে বলল, ‘না! আমি বাড়ি যাব! আমাকে যেতে দাও!’
সোলেমান গাজির চিৎকার শুনে বুড়ো চাকর এবং আরও দু’জন ছেলে ঘরে ঢুকল। ছেলে দু’জন মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল।
মেয়েটা চিৎকার করছে আর বলছে, ‘আমাকে বাঁচান! আমাকে বাঁচান! এরা আমাকে মেরে ফেলবে!’
ছেলে দু’জন তার হাত ধরে টানতে লাগল। তাদের জোরের কাছে হার মানবে না যেন মেয়েটা! সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রীও মেয়েটাকে চেপে ধরলেন। মেয়েটার ব্যাগটা নীচে পড়ে যেতেই মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন জিনিস। টেনে হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো মেয়েটাকে। এখনও শোনা যাচ্ছে তার চিৎকার। বোঝা যাচ্ছে কেউ তাকে মারছে।
রফিক সাদি লক্ষ করলেন, মেঝেতে মেয়েটার চিরুনি, ছোট আয়না, ক্লিপ, কিছু কাগজপত্র ছড়িয়ে আছে। তিনি নিচু হয়ে লেমিনেটিং করা একটা কাগজ তুলে নিলেন। মনে হচ্ছে ওটা আইডি কার্ড। এক ঝলক চেয়েই তিনি দ্রুত পকেটে পুরলেন আইডি কার্ডটা। হঠাৎ কমে এল মেয়েটার চিৎকার।
সোলেমান গাজি ও তাঁর স্ত্রী আবার ঘরে ঢুকলেন।
সোলেমান গাজি বললেন, ‘ও আমার দূরসম্পর্কের বোনের মেয়ে। আমার কাছেই মানুষ হয়েছে। মাথার ঠিক নেই।’
রফিক সাদি দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন। এখান থেকে বেরুতে পারলে বাঁচেন। ‘আমি আজ উঠি।’
‘আচ্ছা। ঠিক আছে।’
রফিক সাদিকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে এলেন না কেউ। বাড়ি থেকে বের হয়ে তাঁর মনে হলো, কিছু একটা যেন অনুসরণ করছে। আনমনেই হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির পিছন দিকে চলে এলেন। কী আশ্চর্য, পিছনে অনেকখানি খোলা জায়গা। দূরে কবরস্থান আছে বলে মনে হচ্ছে। কবরস্থানের পাশেই মাঠ। বোঝা যাচ্ছে, নিয়মিত জায়গাটার পরিচর্যা করা হয়। বেশিক্ষণ সেখানে থাকার সাহস হলো না রফিক সাদির। তিনি হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন। এবার প্রতিটা বাড়ির মানুষগুলোকে ঘরের বাইরে দেখতে পেলেন। সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। সবারই গা উদোম এবং সবার শরীরেই সেই অদ্ভুত উল্কি। রফিক সাদির কেন জানি মনে হচ্ছে, মানুষগুলো হিংস্র জন্তুর মত ঝাঁপিয়ে পড়বে। সবার চোখের দৃষ্টি কঠোর থেকে কঠোরতম হচ্ছে।