‘হ্যাঁ। জয় মোবাইল ব্যবহার করে না।’
‘কাল রাতে না তুই জয়ের সাথে মোবাইলে কথা বলছিলি?’ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘তুমি কী করে জানলে?’ ভুরু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করল নুযহাত।
‘পানি খেতে ডাইনিং রুমে গিয়েছিলাম, তখনই মনে হলো তুই কারও সাথে কথা বলছিস।’
‘আমার মোবাইল কাল রাতে ড্রইংরুমে চার্জে দেয়া ছিল, আমি কাল রাতে কারও সাথে মোবাইলে কথা বলিনি,’ ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল নুযহাত।
‘ও, আচ্ছা। তা হলে হয়তো ভুল শুনেছি।’
‘তুমি আজই জয়দের বাসায় যাও। ওর সাথে আমার কথা হয়েছে, ওর বাবা- মা আজই তোমাকে যেতে বলেছেন। ‘
নুযহাতের কথা কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে রফিক সাদির। একটু আগেই বলল, জয়ের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ হয় না, আবার বলছে, জয়ের সাথে কথা হয়েছে।
‘ঠিক আছে, যাব, মা।’
‘ঠিকানা জানো?’
‘হ্যাঁ, জয় বলেছিল, আমি খুঁজে নেব। চিন্তা করিস না।’
‘বাবা, এমনভাবে কথাবার্তা ঠিক করবে, যেন এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। কোনও অনুষ্ঠানের দরকার নেই।’
‘তুই আমার একমাত্র মেয়ে, তোর বিয়েতে কোনও অনুষ্ঠান হবে না? আর এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ে হতে হবে কেন?’
‘আমি এত কিছুর ব্যাখ্যা তোমাকে দিতে পারব না।’
‘আচ্ছা, আমি আজই যাব। এক সপ্তাহ না, তার আগেই তোর বিয়ে দেব।’ রাগটা সামলানোর চেষ্টা করেন রফিক সাদি।
‘এলেমদারি বনে ঢুকলেই বেশ কিছু বাড়ি-ঘর দেখতে পাবে,’ বাবার ভ্রূক্ষেপে পাত্তা না দিয়ে বলল নুযহাত। ‘জঙ্গলের কিছু জায়গা সাফ করে গোটা দশেক পরিবার সেখানে বসবাস করছে। তাদের যে-কারও কাছে জিজ্ঞেস করলেই ঝমঝম কুঠি দেখিয়ে দেবে।’
‘ঝমঝম কুঠি?’
‘ওটাই জয়দের বাড়ি।’ কথা শেষ করেই ঘুরে হাঁটতে শুরু করল নুযহাত। রফিক সাদি লক্ষ করলেন পা টলছে মেয়েটার। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না।
সাধনা – ৫
পাঁচ
মহসিন গাড়িটা ব্রেক করল। পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাই, এটাই এলেমদারি বন।’
রফিক সাদি গাড়ি থেকে নামলেন। একটা ছোট সাইনবোর্ড নজরে পড়ল। সেখানে লেখা: ‘এলেমদারি বন। অবাঞ্ছিত ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। গাড়ি বা কোনও যানবাহন নিয়ে ভিতরে ঢুকবেন না।’
রফিক সাদি বললেন, ‘তুমি গাড়িতেই থাকো। আমি এক ঘণ্টার ভিতর আসছি। আর যদি আরও দেরি হয়, তোমাকে আমি ফোনে জানাব।’
‘ঠিক আছে, ভাই।’
একটা আধপাকা সড়ক বনের মধ্যে চলে গেছে। রফিক সাদি সেই পথেই হাঁটা শুরু করলেন। বনের পরিবেশটা আশ্চর্যরকম নীরব। পাখির ডাক নেই, পাতার খসখস শব্দ নেই, এমনকী বাতাসের চঞ্চলতাও নেই। বুকের মধ্যে কেমন যেন কাঁপুনি উঠল তাঁর, পায়ের শব্দ যেন নীরবতা ছাপিয়ে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ছে। কিছুদূর হাঁটার পর কিছু বাড়ি দেখতে পেলেন। সবগুলোই টিনের বাড়ি। তবে বাড়ির ভিতর থেকেও কোনও শব্দ আসছে না। রফিক সাদি একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে দেখে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। লোকটার মাথায় একটাও চুল নেই। সবসময় মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে লুঙ্গি ছাড়া কিছু নেই। গলা থেকে তলপেট পর্যন্ত উল্কি আঁকা। অদ্ভুত ধরনের উল্কি। একটা মানুষের অবয়ব বলে মনে হচ্ছে। রফিক সাদির কেন জানি মনে হচ্ছে, এই অবয়বটাকে তিনি চেনেন। যেন উল্কি আঁকা মানুষটা রফিক সাদির দিকে তাকিয়ে হাসছে।
রফিক সাদি উল্কি থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঝমঝম কুঠিটা কোন্ দিকে?’
প্রশ্নটা শুনে মানুষটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কোনও জবাব দিল না। মনে হচ্ছে কথাটা বুঝতে পারছে না।
রফিক সাদি তাগাদা দিলেন, ‘ঝমঝম কুঠিটা কোন্ দিকে?’
লোকটা এবারও জবাব দিল না। তবে তার চোখের উজ্জ্বলতা একটু বাড়ল। ইশারায় ডানদিকে যেতে বলল।
রফিক সাদি ডানদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। আরও চার-পাঁচটা টিনের বাড়ি চোখে পড়ল। কোনও বাড়িতেই তেমন লোকজন চোখে পড়ছে না। মিনিট পনেরো হাঁটার পর ঝমঝম কুঠিটা দৃষ্টিগোচর হলো। পুরনো ধাঁচের বিশাল এক দোতলা বাড়ি। কোথাও-কোথাও খসে পড়েছে চুন ও পলেস্তারা। বাড়ির সামনে জন্মেছে রাজ্যের আগাছা। শ্যাওলাতে সবুজ রং ধারণ করেছে বাড়ির কিছু অংশ। সদর দরজাটা ধাক্কা দিলেন রফিক সাদি। কিছুক্ষণ পর বুড়ো মত এক লোক এসে দরজা খুলে দিল। পোশাক-আশাকে মনে হচ্ছে বাড়ির চাকর।
রফিক সাদি বললেন, ‘আমি রফিক সাদি। জয়ের বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি। উনি কি আছেন?’
বুড়ো লোকটি মাথা দোলাল। শোনা যায় না প্রায়, এমন গলায় বলল, ‘আসুন। আমার সাথে দোতলায় আসুন।’
রফিক সাদি অনুসরণ করলেন লোকটিকে। ভুলও হতে পারে, তবে কেন যেন মনে হচ্ছে দোতলায় একটা মেয়ে কাঁদছে।
দোতলায় বাইরের এক রুমে তাঁকে বসতে দেয়া হলো। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল। ভিতর ঘর থেকে কারও উত্তেজিত কথা শোনা যাচ্ছে, একইসাথে পাওয়া যাচ্ছে এক মেয়ের চাপা কান্নার আওয়াজও। খানিকক্ষণ পর বাড়ির পরিবেশ কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। ঠিক তখন একজন পুরুষ এবং মহিলা ঘরে ঢুকলেন। রফিক সাদি বুঝতে পারলেন এঁরাই জয়ের মা-বাবা।
রফিক সাদি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন? আমি নুযহাতের বাবা।’
জয়ের বাবা মাথা দোলালেন। মাথায় কোনও চুল নেই। গা উদোম। ঘামে পুরো শরীর ভেজা।
রফিক সাদি লক্ষ করলেন, মানুষটার শরীরে উল্কি আঁকা। প্রথমে বনে ঢুকে যে লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেই লোকটার মত একই উল্কি।