‘কবে যাব এখনও ঠিক করিনি। আগে জয়ের বাবা-মা’র সাথে কথা বলি।’
‘ইয়ে…মানে, বাবা, বিয়ের কথা একটু দ্রুত এগুলে ভাল হত।’
রফিক সাদি কিছুটা বিরক্ত হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। ‘ঠিক আছে, মা। দ্রুতই করব। জয়কে বল, তার মা-বাবাকে দিয়ে আমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে। ছেলেপক্ষ বিয়ের প্রস্তাব না পাঠালে, কথাবার্তা এগোবে কীভাবে?’
কঠিন গলায় নুযহাত বলল, ‘বাবা, ওঁরা কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন না। তোমাকেই ওঁদের বাসায় যেতে হবে।’
‘আমি প্রস্তাব নিয়ে যাব!’
‘হ্যাঁ। সেকালের ধারণা নিয়ে বসে থাকলে তো মুশকিল, বাবা। ছেলেপক্ষকেই সবসময় প্রস্তাব পাঠাতে হবে, এমন কোনও লিখিত নিয়ম আছে?’
‘তুই এত রেগে-রেগে কথা বলছিস কেন?’
‘আমি মোটেই রেগে কথা বলছি না,’ চেঁচিয়ে বলল নুযহাত। ‘তোমার স্বার্থপরতায় অবাক হচ্ছি শুধু!’
‘স্বার্থপরতা?’ বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন রফিক সাদি।
‘হ্যাঁ। তুমি মনে করো, আমার বিয়ে হলে তুমি একা হয়ে যাবে। তাই এ ব্যাপারে তোমার কোনও আগ্রহ নেই।’
নুযহাতের কথায় খুব কষ্ট পেলেন রফিক সাদি। বললেন, ‘মা রে, তুই হয়তো ঠিকই বলেছিস, তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি একা হয়ে যাব। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি খুব দ্রুতই জয়ের সাথে তোর বিয়ে দেব।’
নুযহাত বাবার দিকে না তাকিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল। রফিক সাদি লক্ষ করলেন, তার হাতে বেশ কয়েকটা তাবিজ সদৃশ জিনিস বাঁধা। তিনি সেগুলো তেমন গ্রাহ্য করলেন না। নিশ্চয়ই নতুন ফ্যাশন। কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ এত খেপে গেল কেন? সে কি কোনও সমস্যায় পড়েছে? হঠাৎ করেই নিজের স্ত্রীর কথা মনে হলো রফিক সাদির।
.
রাত কত হয়েছে জানেন না রফিক সাদি। ইজিচেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কেন জানি হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেছে। মনে হলো ঘরের ভিতর কোনও ঝামেলা হয়েছে। ঝামেলাটা কী তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। মনের ভিতর কেমন যেন এক ধরনের অস্বস্তি। তিনি ধীর পায়ে নুযহাতের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রুমে বাতি জ্বলছে। নিচু গলায় নুযহাত কারও সাথে মোবাইলে কথা বলছে। লুকিয়ে মেয়ের কথা শোনা এক ধরনের অপরাধ, তবু তিনি কৌতূহল দমাতে পারলেন না।
নুযহাত বলছে, ‘আমি বাবাকে বলেছি। বাবা দুই-একদিনের মধ্যেই তোমাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।
ওপাশ থেকে কিছু বলা হলো।
নুযহাত করুণ গলায় বলল, ‘বুঝতে চেষ্টা করো, আমাদের বিয়ে হওয়াটা জরুরি। না, না, আমার বাবা কখনোই অমন মানুষ নন।’
আবার ওপাশ থেকে কিছু বলা হলো।
নুযহাত উত্তেজিত গলায় বলল, ‘কী? বাবা তোমার সাথে খারাপ আচরণ করেছেন? এ কথা আগে বলোনি কেন? ঠিক আছে, আমি বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না…’
কথোপকথন চলতে লাগল।
রফিক সাদির মনে হলো তিনি ভুল শুনেছেন। তিনি তো জয়ের সাথে কোনও খারাপ ব্যবহার করেননি। তা হলে এসব কথার মানে কী? একটু পরে তিনি নুযহাতের কান্নার শব্দ শুনলেন। নিচু স্বরে কাঁদছে মেয়েটা। রফিক সাদির মনের ভিতর ওলট-পালট হতে থাকল। ইচ্ছা হচ্ছে দরজা নক করে মেয়ের সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু মেয়েটা হয়তো এসব ভালভাবে নেবে না। তাই তিনি নিজ রুমে ফিরে গেলেন। কিন্তু বাকি রাত তাঁর ঘুম হলো না।
চার
সকালে রফিক সাদি বাসার সামনে ছোট বাগানে পায়চারি করছেন। ড্রাইভার মহসিন এসে পিছন থেকে সালাম দিল। ‘বড় ভাই, আসসালামুলাইকুম।’
পঁচিশ বছর ধরে মহসিন এই বাসায় আছে। রফিক সাদি নীচতলার দু’রুম মহসিনের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। মহসিন তার স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেখানে থাকে। বাড়ির ড্রাইভার হলেও রফিক সাদির সাথে তার এক ধরনের বন্ধুত্ব আছে। রফিক সাদিকে সে বড় ভাই বলে ডাকে।
‘অলাইকুম আসসালাম,’ বললেন রফিক সাদি।
‘কিছু নিয়ে ভাবছেন?’
অন্য কেউ হলে রফিক সাদি এড়িয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেন। কিন্তু মহসিনকে তিনি ছোট ভাইয়ের মতই মনে করেন।
‘কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছি। তোমাকে সময় করে বলব।’
‘বুঝতে পারছি মামণিকে নিয়ে চিন্তা করছেন।’
‘মেয়ে বড় হলে বাবার চিন্তা তো বাড়েই, আর মা-মরা হলে তো বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।’
‘ভাই, আজ কি অফিসে যাবেন?’
‘মনে হয় না। অফিসের কাজে মন দিতে পারি না। ম্যানেজারই এখন সব দেখাশোনা করছে। তবে আজ বাইরে বের হব।’
‘কোথায় যাবেন?’
‘কিছুক্ষণ পরে বলছি।’
মহসিন লক্ষ করল, নুযহাত আসছে। এজন্যই হয়তো রফিক সাদি চুপ করে গেলেন। তিনি চোখের ইশারায় মহসিনকে চলে যেতে বললেন।
এক রাতেই নুযহাতের চেহারায় কেমন যেন একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে চোখগুলো, এলোমেলো হয়ে আছে মাথার চুল, কয়েকটা ব্রণও উঠেছে মুখে। মনে হচ্ছে রাতে একটুও ঘুম হয়নি।
রফিক সাদি মেয়েকে দেখে ভিতরে-ভিতরে চমকে উঠলেও স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘মা, ঘুম ভাঙল?’
নুযহাত বাবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মনে হলো বাবার কথা শুনতে পাচ্ছে না।
রফিক সাদি নিজেই আবারও বললেন, ‘আজই জয়দের বাসায় যাব ভাবছি। কিন্তু জয়ের বাবার মোবাইল নাম্বারটা আমার কাছে নেই। তুই জয়ের নাম্বারটা আমাকে দিস।’
‘জয়ের নাম্বার আমার কাছে নেই।’
‘কী? নাম্বার নেই!’ নিজের বিস্ময়টুকু লুকাতে পারলেন না তিনি।