‘আচ্ছা, ঠিক আছে, কাল থেকেই নিয়মিত অফিসে যাব।’
‘হুঁ, মনে থাকে যেন।’
‘তুই তো দিন-দিন আমার মায়ের মত হয়ে যাচ্ছিস। কোথায় তোকে সান্ত্বনা দেব, উল্টো তুই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস।’
‘বাবা, তোমার কালো মুখ দেখলে আমার কষ্ট হয়।’
‘আচ্ছা, মা। আর মুখ কালো করে রাখব না। শুধু হাসব।’
‘গুড বয়।’ বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল নুযহাত। ‘বাবা, তোমাকে কিছু বলতে চাই।’
‘অনুমতি নিচ্ছিস কেন? সরাসরি বলে ফেল।’
‘আমার বয়স গত ফেব্রুয়ারিতে ছাব্বিশ হয়েছে,’ নুযহাতের মাথা নিচু ‘হ্যাঁ। তা তো আমি জানিই।
‘সব বাবার উচিত সঠিক সময়ে সঠিক পাত্রের হাতে মেয়েকে পাত্রস্থ করা।’ বাবার দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে ওর।
রফিক সাদি কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হো-হো করে হেসে উঠলেন। মেয়ের কান ধরে বললেন, ‘এমন কথা শিখেছিস কোথা থেকে?
‘বাবা, হেসো না। আমার লজ্জা লাগছে।’
‘আমি তো বেশ কিছুদিন ধরেই তোর বিয়ে নিয়ে ভাবছি। তোর কথায় আরও একটু জোর পেলাম। তোর কোনও পছন্দ আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ, আছে।’
‘কী করে ছেলে? নাম কী?’
‘আমাদের সাথেই মাস্টার্সে পড়ছে। নাম জয়।’
‘ওহ্। চাকরি করছে না?’
‘বাবা, ওর আসলে চাকরি না করলেও চলবে। ওদের প্রচুর জায়গা-জমি। নানা ধরনের ব্যবসাও আছে।’
‘তবু ছেলে চাকরি না করলে, কেমন যেন দেখায় না ব্যাপারটা?’
‘চাকরি একসময় নিশ্চয় করবে। আপাতত ওর বাসা থেকে বিয়ে নিয়ে খুব তাগাদা দিচ্ছে।‘
‘ও, আচ্ছা, ঠিক আছে। ছেলেটাকে নিয়ে আয় একদিন।’
‘কালই আনি, বাবা?’
‘হ্যাঁ। দুপুরে আমার অফিসে আসতে বলিস।’
‘অফিসে কেন?’ নুযহাতের জিজ্ঞাসা।
‘ওর সাথে একটু সিরিয়াস বিষয়ে কথা বলতে চাই।’
‘ঠিক আছে, বাবা। ওকে অফিসেই যেতে বলব।’ চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলল নুযহাত। ‘বাবা, চা খাবে?’
‘হ্যাঁ, দে।’
নুযহাত চা আনতে গেল। চোখে-মুখে খেলা করছে আনন্দ।
রফিক সাদির একটু বিষণ্ণ লাগছে। আসলে এত তাড়াতাড়ি তিনি মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবছিলেন না। মেয়েটার বিয়ে হলে বড্ড একা হয়ে যাবেন। কিন্তু সবারই একটা নিজস্ব জীবন আছে। নুযহাতেরও অবশ্যই অধিকার আছে নিজের মত করে জীবনটাকে সাজিয়ে নেয়ার।
আবারও চোখে পানি এল তাঁর। দ্রুত চোখের পানি মুছলেন।
মেয়েকে চোখের পানি দেখাতে চান না রফিক সাদি।
দুই
ছেলেটির বসার ভঙ্গিটা বেশ অদ্ভুত। একদম সটানভাবে চেয়ারে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন সবে মাত্র আর্মির ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছে। গায়ের রং শুধু কালো বললে ভুল হবে, পাতিলের তলাও তার চেয়ে উজ্জ্বল। চোখে কোনও প্রশ্ন বা উত্তেজনার ছাপ নেই। তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। পেশিবহুল হাতদুটো রেখেছে টেবিলের উপর। নিশ্চয়ই নিয়মিত ব্যায়াম করে। এমন শরীর বানানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। রফিক সাদির দৃষ্টি জয়ের শরীরে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
হাসিমুখে বলল জয়, ‘আপনি আমাকে আজ দেখা করতে বলেছিলেন।’
‘তুমি জয়?’
‘হ্যাঁ।’ কোনও সামাজিক সম্ভাষণের মধ্যে যায়নি জয়। তার কথাবার্তা একদম সরাসরি।
রফিক সাদির কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। ভেবেছিলেন জয় ছেলেটা নার্ভাস থাকবে, উল্টো তাঁর নিজেরই নার্ভাস লাগছে। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বললেন, ‘তোমার বাবা কী করেন?’
জয়ের চোখ কিছুটা সরু হয়ে এল। ‘বাবার নানা ধরনের ব্যবসা আছে।’
‘ও। তোমাদের বাসা কোথায়?’
‘ময়মনসিংহের কাছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এলেমদারি নামে একটা ছোট বন আছে।’
‘এলেমদারি বনের নাম শুনেছি।’
‘এলেমদারি বনের মধ্য দিয়ে আধা পাকা রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে ১৫-২০ মিনিট হাঁটলেই হাতের ডান পাশে আমাদের বাড়ি দেখতে পাবেন।’
‘বনের মধ্যে বাড়ি?’
‘বন এখন আর আগের মত ঘন নেই,’ আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল জয়। ‘আমার দাদা ইংরেজদের কাছ থেকে নিলামে এই বনের জায়গাটা কিনে নেন, তারপর সেখানে বাড়ি তৈরি করেন। গত সত্তর বছর ধরে আমরা ওখানে আছি।’
‘কিন্তু একদম একা-একা বনের মধ্যে থাকো, কোনও সমস্যা হয় না?’
‘একা কোথায়? আমাদের ওখানে আরও অনেকগুলো বাড়ি উঠেছে। বাবা বেশ খানিক জায়গা ইতিমধ্যে বিক্রিও করে দিয়েছেন। তবে সমস্যা একটা আছে।’
‘কী সমস্যা?’
‘বনবিভাগ এলেমদারি বনের বেশিরভাগ জায়গা নিজেদের বলে দাবি করছে। এজন্য আদালতে মামলা চলছে। তবে আশা করি আমরাই জিতব।’
জয়ের আত্মবিশ্বাসটা চোখ এড়াল না রফিক সাদির। ‘তো একদিন তোমার বাবা-মাকে আমাদের বাসায় আসতে বলো।’
‘আমার মা-বাবা তেমন একটা বাইরে বেরুতে চান না। তার চেয়ে আপনি একদিন আসুন আমাদের বাসায়। জায়গাটা আপনার ভাল লাগবে।’
জয়ের বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল। রফিক সাদির মনে হলো, আসলেই সেখানে যাওয়া দরকার।
‘আমি তা হলে আজ উঠি।’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। তোমার বাবার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যাও।’
‘আমাদের ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কে সমস্যা আছে। তাই সবসময় মোবাইলে পাওয়া যায় না। এই নিন বাবার নাম্বার।’
জয় পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দিল।
তবে কি আগেভাগেই মোবাইল নাম্বার লিখে এনেছে?
ভাল বুদ্ধি তো ছেলেটার!
জয় চলে যাওয়ার পর রফিক সাদি কাগজটার দিকে তাকালেন। জয় যে মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে গেছে তাতে দুটো ডিজিট কম।
কয়েক মুহূর্ত পর রফিক সাদির মুখে ফুটে উঠল চিন্তার ছাপ।
তিন
‘বাবা, তুমি এলেমদারি কবে যাবে?’