নার্গিস জাহান আনোয়ারকে নিয়ে এসেছেন নিজ বাসায়। আনোয়ারের বাবা প্রথমে রাজি হতে চাইছিলেন না। কিন্তু আনোয়ারের এখন দরকার পূর্ণ যত্ন। আর নিজ বাড়িতে সেবা করার মত কেউ নেই। এই যুক্তির কাছে আনোয়ারের বাবা পরাজিত হয়েছেন। তিনি ব্যবসার কাজে সবসময় ব্যস্ত থাকেন। মাসের মধ্যে একবার তাঁকে দেশের বাইরেও যেতে হয়। তাই নার্গিস জাহানের কাছেই ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছেন তিনি। প্রতিদিন একবার এসে দেখে যান ছেলেকে।
নাদিয়ার শরীরের উপর দিয়ে এই কয়েকদিন অনেক ধকল গেছে। এখন আনোয়ারের অবস্থা অনেক ভাল। তার দায়িত্ব অনেক কমেছে। তাই অনেকদিন পর সে দশ ঘণ্টার টানা ঘুম দিল। জেগে উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিল। আজ দোতলার রেহানার কাছে যাওয়ার ইচ্ছা তার। মেয়েটাকে ওর খুব পছন্দ। কী সাধাসিধে মিষ্টি মেয়ে। সেজান এবং রেহানা এই বাসায় এসেছে দুই মাস হলো। দুই মাসেই রেহানার সাথে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নাদিয়ার। দোতলার অন্য ফ্ল্যাটের রহমত সাহেব নাকি অসুস্থ। তাঁকেও দেখতে যাওয়া উচিত। তাঁর নাকি সমস্যা হয়েছে মেরুদণ্ডের হাড়ে। তিনি এখন মোটামুটি শয্যাশায়ী। তাঁর স্ত্রী মোরশেদা গতকাল কাঁদতে-কাঁদতে নাদিয়াকে বলেছে, ‘কী যে হলো মানুষটার! আমি বাচ্চাদের নিয়ে একটু বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। এর মধ্যে একদিন উনি বাথরুমে পড়ে যান। কাঁধ, পিঠ এবং কোমরে খুব আঘাত পেয়েছেন। ডাক্তার বলল, মেরুদণ্ডে নাকি সমস্যা। এখন পুরো শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। বিছানা থেকে ঠিকমত উঠতেও পারেন না।’
.
রেহানাদের বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল নাদিয়া।
দরজা খুলতে অনেক দেরি হলো রেহানার। আজকাল দরজা খুলতে কেমন যেন আতঙ্ক লাগে। সেদিন রহমত আলী বাসায় আসার পর যেসব ঘটনা ঘটেছিল, কাউকে সেসব বলেনি। সেজানকেও না।
রেহানার দিকে তাকিয়ে নাদিয়া বলল, ‘এই, কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ নাকি?’
‘না, আপা। শরীর খারাপ না।’
‘ভাল কোনও সুসংবাদ আছে নাকি?’
রেহানা লজ্জা পেল। বলল, ‘কী যে বলেন, আপা। এত তাড়াতাড়ি না।’
‘থাক-থাক, আর লজ্জা পেতে হবে না। তুমি তো এই কয়েকদিনে অনেক শুকিয়ে গেছ। কোনও বিষয় নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছ নাকি?’
‘তেমন কিছু না, আপা।’ কথা বলার সময় হতাশাটা লুকাতে পারল না রেহানা।
‘বুঝতে পারছি তোমার একান্ত ব্যক্তিগত কোনও বিষয়। আমি অন্যের গোপন কথা শুনতে চাই না। তবে কোনও বিষয়ে সাহায্য লাগলে আমাকে বলবে। আমি ভাল পরামর্শ দিতে পারি।’
‘জী, আপা, অবশ্যই বলব,’ শুষ্ক গলায় বলল রেহানা।
রেহানার সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে চলে এল নাদিয়া। বুঝতে পেরেছে, রেহানা কোনও সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়ে। কিন্তু এত অল্প বয়সেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে। কে জানে, হয়তো স্বামীর সাথে মানিয়ে চলতে পারছে না।
.
নাদিয়া চলে যাওয়ার পর ভয়ের ভাবটা ফিরল রেহানার। সেজান কখন যে বাসায় আসবে! ওকে নিয়ে খুব বিপদে পড়েছে মানুষটা। প্রায়ই আজব সব ব্যাপার ঘটছে ঘরে। সেদিন সেজান নিজ থেকেই বলল, ‘বাসাটা ভাল না। ভাবছি নতুন বাসায় উঠব।’
রেহানা সম্মতিসূচক মাথা নেড়েছে। সে মুখ ফুটে বলতে পারেনি যে, বাসা বদলালেও কাজ হবে না কোনও। হয়তো একমাত্র রেহানার মৃত্যুই সব ঠিক করতে পারে। আচ্ছা, নাদিয়া আপাকে কি সব বলা যায়? আপাকে দেখলে কেমন যেন একটু ভরসা হয়। আর আপা সাহায্য করতে পারুক বা না পারুক, সব জানলে হয়তো ওর পাশে থাকবেন। নাকি আপার আবার কোনও বিপদ হবে?
রেহানা ঠিক করল, ওর ডায়রিটা দিয়ে আসবে আপাকে। ওটা পড়লেই ওর সমস্যা সম্পর্কে জানা যাবে।
পাঁচ
নাদিয়ার রুমে বসে আছে রেহানা।
ওকে একগাদা খাবার খেতে দিয়েছে নাদিয়া। খুব মজা করে আপেল খাচ্ছে রেহানা। দৃশ্যটা দেখতে ভাল লাগছে নাদিয়ার।
ওর দিকে তাকিয়ে রেহানা বলল, ‘আপা, আমি আসলে অনেক বড় বিপদে আছি। কেন জানি আপনাকে সব বলতে ইচ্ছা করছে।’
‘অবশ্যই বলবে। আমি মন দিয়ে তোমার কথা শুনব।’
‘মুখে বলব না, আপা। আমার এই ডায়রিটা পড়ুন। আমার সমস্যাটা এই ডায়রিতে লিখে রেখেছি।’
এমন সময় ঘরে ঢুকল আনোয়ার। তাকে দেখে কিছুটা বিব্রত হলো রেহানা। ভালভাবে শরীরে জড়িয়ে নিল ওড়নাটা। আজকাল পুরুষ মানুষ দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।
নাদিয়া বলল, ‘রেহানা, উনি আনোয়ার ভাই। আমার খালাতো ভাই। তাঁকে এত লজ্জার কিছু নেই। আর, আনোয়ার ভাই, ও রেহানা। দোতলায় থাকে।’
রেহানার দিকে তাকিয়ে হাসল আনোয়ার। তারপর বলল, ‘নাদিয়া, তোমরা কথা বলো। আমি ছাদে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা, আনোয়ার ভাই।’
কিছুক্ষণ পর চলে গেল রেহানা।
রেহানার ডায়রি পড়তে শুরু করল নাদিয়া।
আমার নাম রেবেকা আক্তার রেহানা। ছোটবেলা থেকেই রূপগঞ্জ গ্রামে আমি পরিচিত মুখ। কারণ, আমার নানারকম দুষ্টুমিতে সবাই অতিষ্ঠ ছিল। আমার জন্মের কয়েক মাস আগে বাবা মারা যায়। আর যখন আমার বয়স তিন বছর, তখন আমার মা-ও মারা যায়। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আমার বড় মামা-মামী। এমন মামা-মামী পাওয়ার ভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়। মামার দুই ছেলে-মেয়ে। লায়লা আর কবির। আমার সবসময় মনে হত, মামা-মামী নিজ সন্তানের চেয়েও আমাকে বেশি ভালবাসতেন।