মাথা নিচু করে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘খবরদার তুমি আর বাথরুমে ঢুকবে না কখনও।’
‘ঠিক আছে,’ নিরুপমা বলল। ‘তুমি একটু আমার সাথে এসো।’
‘কোথায়?’
নিরুপমা উঠে দাঁড়াল। বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দিপু পিছু- পিছু গেল। নিরুপমা বাথরুমের ছিটকিনিটা খুলে ফেলল। দিপু আঁতকে উঠে বলল, ‘এ কী করছ? বাথরুমে ঢুকছ কেন?’ সে দৌড়ে গিয়ে নিরুপমার হাত চেপে ধরল।
ততক্ষণে দরজাটা পুরো খুলে ফেলেছে। ভিতরটা তীব্র অন্ধকার।
‘এদিকে এসো, দিপু!’ নিরুপমার কণ্ঠে আহ্বান।
‘নিরুপমা, তুমি কী করছ?’
‘আমার কাছে এসো।’ নিরুপমার গলায় কাতরতা।
দিপু নিরুপমার আরও কাছে গেল।
নিরুপমা বলল, ‘বাথরুমের ভিতরটা একটু দেখো!’
‘কী দেখব?’
‘তোমার দেখা প্রয়োজন।’
দিপুর সবকিছু এলোমেলো লাগছে। এসব কী করছে নিরুপমা?
দিপু বাথরুমের দরজা দিয়ে খানিকটা ভিতরে ঢুকল। সেই মুহূর্তে নিরুপমা দিপুকে সজোরে ধাক্কা দিল। দিপু তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে গেল। নিরুপমা বাইরে থেকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। অন্ধকার, ভয়ঙ্কর অন্ধকারে দিপু ক্রমশ তলিয়ে যেতে লাগল।
দিপু উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মত দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। ‘নিরুপমা, নি- নিরুপমা। দরজা-দরজা খোলো।’
নিরুপমার কথা শুনতে পাচ্ছে দিপু। কাঁদতে-কাঁদতে নিরুপমা বলছে, ‘আমাকে মাফ করে দিয়ো, দিপু। আমি তোমার কোনও কথা শুনতে পাচ্ছি না। বাথরুমের ভিতরের শব্দ বাইরে থেকে শোনা যায় না।’
একটু থেমে আবার বলল, ‘এলিনা সেদিন আমাকে কী বলেছিল তোমাকে বলা হয়নি। এলিনা সেদিন আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আর বলেছিল, সে কোনও পুরুষকে দিয়ে তার খিদে মেটাতে চায়। আমাকে ত্রিশ দিন সময় দিয়েছিল। এর মধ্যে আমার ভালবাসার মানুষটিকে ওকে দিতে হবে। নয়তো আমাকে বাঁচতে দেবে না। বাথরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে শেষ করবে। তার সব আক্রোশ পুরুষদের প্রতি। সাত বছর ধরে অপেক্ষায় আছে এলিনা। আমি ওর কথায় রাজি হয়েছিলাম। এরপর বাথরুম থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। তবু নিজেকে বাঁচানোর জন্য কাজটা করতে হয়েছে আমাকে। আমি বাবাকে দ্রুত বিয়ের আয়োজন করতে বলি। অবশ্য তাঁকেও এই বিষয়টা খুলে বলা হয়নি। এদিকে এলিনা প্রায়ই আমার স্বপ্নে আসে। আমাকে সবকিছু বারবার মনে করিয়ে দেয়। এই কারণেই আমি আগেভাগে বারবার তোমার কাছে মাফ চেয়েছি। একটু পর তোমার খণ্ডিত লাশটা বাথরুমে খুঁজে পাওয়া যাবে। সবাই ভাববে তুমি বাথরুমে ঢুকেছিলে, তাই এই বিপত্তি ঘটেছে। এখানে আমার দোষের কথা কারও মাথায়ও আসবে না।’
দিপু আর কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। সম্ভবত নিরুপমার আর কিছু বলার নেই। দিপু চিৎকার করছে, ‘বাঁচাও। কেউ আমাকে বাঁচাও।’
বাথরুমের মধ্যে একটা পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। কেউ পা টেনে-টেনে হাঁটছে। বুঝতে পারল এলিনা তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাঁপা গলায় বলল দিপু, ‘আ-আ-আমাকে মেরো না।’
এলিনার গরম নিঃশ্বাস দিপুর শরীরে লাগছে।
ভাঙা গলায় এলিনা বলল, ‘খিদে লেগেছে। কতদিন পুরুষের মাংস খাইনি। অ-অ-অনেক দিন-ন-ন্।’
এলিনা দিপুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। দিপু হাল ছেড়ে দিল। দিপু জানে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে ভয়ঙ্কর বোধহয় আর কিছু নেই।
দিপু নিরুপমার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। নিরুপমা বলছে, ‘বাবা, ও, বাবা, দিপু বাথরুমে ঢুকেছে, বাবা, আমি অনেক নিষেধ করেছিলাম, তবু ঢুকেছে।’
সেলিম চাচা বলছেন, ‘এ কী বলছিস? চিন্তা করিস না, মা। আমি দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করছি।’
পুরো বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল। দরজা ভাঙার আয়োজন চলছে। এলিনা দিপুর বুকের উপর উঠে বসেছে। দিপু জানে, সেলিম চাচা বাথরুমের দরজা ভাঙার আগেই মেয়েটা তার খিদে মিটিয়ে ফেলবে।
সাধনা
সাধনা – ১
এক
বাবাকে বারান্দায় আসতে দেখে নুযহাত বলল, ‘বাবা, সুপ্রভাত।’
‘সুপ্রভাত, মা,’ মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন রফিক সাদি।
‘কখন উঠেছিস তুই?’
‘অনেক আগে, ভোরে।’
‘ভোরে ওঠা তো তোর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, ভাল।’
‘তুমিও আগে অনেক ভোরে উঠতে। আমাকে কতবার বলেছ, সকালের প্রথম আলো শরীরে মাখলে দূর হয় সব অমঙ্গল।’
‘ঘুম ভেঙে যায় আগেই। কিন্তু বিছানা থেকে আর উঠতে ইচ্ছা করে না।’
‘বাবা, আম্মু মারা যাওয়ার পর অনেক বদলে গেছ তুমি। স্ত্রী মারা গেলে এত কষ্ট পায় পুরুষমানুষ, তোমাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। ‘
‘তোর মাকে হারিয়ে আমার মধ্যে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনও কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়,’ দূরে তাকিয়ে বললেন রফিক সাদি। —কিছু কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না।’
‘কষ্ট কি আমি কম পেয়েছি, বাবা? কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে স্বাভাবিক হতে হয়। প্রায়ই আড়াল থেকে দেখি, মায়ের ছবি বের করে তুমি কাঁদছ।’ নরম সুরে বলল নুযহাত, ‘তুমি অফিসে ঠিকমত যাও না। আগে টেনিস খেলতে যেতে, তা-ও ছেড়েছ। আগের মত তোমাকে বই পড়তেও দেখি না। সারাদিন মুখ গম্ভীর করে বসে থাকো।’
‘কিছু ভাল লাগে না রে,’ অপরাধীর মত বললেন রফিক সাদি। আমাকে আরও একটু সময় দে, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কচু ঠিক হবে,’ বলল নুযহাত, ‘গত এক বছরে যখন ঠিক হয়নি, তখন হবেই না।’