‘যারা মারা গিয়েছিল তাদের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল কিছু জানা গিয়েছিল?’
‘প্রত্যেকেরই শরীরের খণ্ডাংশ পাওয়া গেছে। কেউ যেন তাদের খুবলে খুবলে খেয়েছে। কিছু হাড়, কিছু মাংস আর রক্ত এদিক-সেদিক পড়ে ছিল। এমন বীভৎস দৃশ্য-কী আর বলব, আমার মত শক্ত মনের মানুষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই গত সাত বছর আমি তিনতলাটা ভাড়া দিইনি। এবার একটু আর্থিক টানাটানির জন্য সেলিম সাহেবের কাছে বাসাটা ভাড়া দিয়েছিলাম। তাঁদের কঠিনভাবে নিষেধ করেছিলাম, কোনওক্রমেই যেন বাথরুমের দরজাটা খোলা না হয়। কিন্তু নিরুপমা মেয়েটা আমার কথা শোনেনি।’
নবির শেখ চিন্তিত গলায় আরও বললেন, ‘বিষয়টা খুবই রহস্যজনক। আজ পর্যন্ত কোনও মানুষ এলিনার কাছ থেকে জীবিত ফিরতে পারেনি। নিরুপমাই প্রথম যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।’
‘হ্যাঁ। নিরুপমা ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গেছে, কিন্তু এখন এলিনা নামের মেয়েটা বলছে, নিরুপমাকে সে মেরে ফেলবে। এখন আমরা কী করতে পারি?’
‘বাসা ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আর কোনও হুজুর ডেকে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, নবির শেখ জবাব দিলেন।
‘কিন্তু এলিনা স্বপ্নে বলেছে, বাসা ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেই মুহূর্তে নিরুপমাকে মেরে ফেলবে।’
‘এখন পর্যন্ত নিরুপমা বেঁচে আছে এটাই আশ্চর্যের।’ চশমাটা খুলে ফেললেন নবির শেখ।
‘আচ্ছা, যে পাঁচজন মারা গিয়েছিল তাদের কতজন নারী আর কতজন পুরুষ?’ দিপু জিজ্ঞেস করল।
নবির শেখের মুখটা আরও একটু গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘তাদের পাঁচজনই পুরুষ ছিল। পুরুষদের কৌতূহল মনে হয় একটু বেশিই থাকে।’
‘আচ্ছা, আপনি কখনও ওই বাথরুমে ঢুকেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। প্রতিটা মৃত্যুর পর পুলিশের সাথে আমিও ঢুকেছিলাম। মৃতদেহগুলো বাথরুমেই পড়ে ছিল। তবে আমার চোখে বাথরুমের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েনি।’
‘আপনি বাথরুমটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেননি কেন?’
‘এটা ভুলই হয়েছিল। আসলে সাত বছর বাড়িটা ভাড়া দেয়া হয়নি, তাই ভেবেছিলাম ওই অশুভ জিনিসটার সম্মুখীন হয়তো আর হতে হবে না। কিন্তু…এবার বাথরুমটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেব।’
পাঁচ
এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কি বিয়ের কথা চিন্তা করা যায়? কিন্তু দুই পরিবার ওদের বিয়ে ঠিক করল। দিপুর আম্মা-আব্বাও পুরো বিষয়টা জানতে পেরেছেন। তাঁরা মনে করছেন বিয়ের পর নিরুপমা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে সব ঝামেলা থেকে মুক্তি মিলবে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর নিরুপমা এলিনাকে আর স্বপ্নেও দেখেনি।
দিপু এখন প্রায় প্রতিদিনই নিরুপমাদের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দিপুকে দেখে নিরুপমা কেন জানি আগের মত খুশি হয় না। তার চোখের নীচে কালি পড়েছে, ব্রণে ভরে গেছে মুখ। আর মাথার চুলগুলো জট পাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে নিজের শরীরের প্রতি কোনও যত্ন নিচ্ছে না। দিপু নিরুপমার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘এ কী অবস্থা তোমার?’
একদিন নিরুপমা কাতর গলায় বলল, ‘আমাকে তুমি মাফ করে দিয়ো।’,’অ্যাই, বোকা মেয়ে, মাফ চাইছ কেন? তুমি কী অপরাধ করেছ?’
নিরুপমা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। বলল, ‘মাফ চাইতে ইচ্ছা হলো, তাই মাফ চাইলাম।’
দিপু বুঝতে পারল নিরুপমার মন থেকে ভয়টা এখনও দূর হয়নি। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি তো কয়েকদিন পরেই সবসময় তোমার সাথে-সাথে থাকব, দেখি কে তোমার ক্ষতি করে।’
‘হুম।’ বোঝা যাচ্ছে দিপুর কথায় নিরুপমা তেমন ভরসা করতে পারেনি।
দিপু কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু বিয়ের রাতে তোমার পিঠের সেই ক্ষতটা দেখব, মনে আছে তো?’
নিরুপমা এবার হাসল। দিপু দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, ‘আর ওইদিন…’
‘ওইদিন কী?’
‘হা-হা। আরও অনেক কিছু করব।’
কেন জানি নিরুপমা আবার কাঁদতে লাগল। বেচারী বড্ড চিন্তায় আছে। দিপু এই মেয়েটাকে কিছুতেই আর কষ্ট পেতে দেবে না, কিছুতেই না।
ছয়
একটা ছোট ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিরুপমা আর দিপুর বিয়ে হলো। অল্প কিছু কাছের মানুষকে দাওয়াত দেয়া হলো। পরবর্তীতে দুই পরিবারের যৌথ উদ্যোগে একটা বড় অনুষ্ঠান করা হবে। বিয়ের রাত। দিপু নিরুপমাদের বাসায়ই থাকবে। পরদিন দুপুরের দিকে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
বাসর রাতে দিপু আর নিরুপমা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশ দেরি হয়েছে, দু’জনেই প্রচণ্ড ক্লান্ত। খুব ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু বাসর রাতে সম্ভবত বোকারাই শুধু ঘুমায়। তাই জেগে রইল ওরা। বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিরুপমা ক্রমাগত কেঁদেছে। এখন অবশ্য শান্তমুখে বসে আছে। তবে চেহারায় কেমন যেন তীব্র বেদনার ছাপও দেখা যাচ্ছে। বিয়ের সময়ে সব মেয়েরই মনে হয় এমন হয়।
দিপু বিছানায় বসতেই নিরুপমা বলল, ‘আমাকে মাফ করে দিয়ো, দিপু।
‘তোমার কী হয়েছে বলো তো। এত মাফ চাইছ কেন? তুমি মারা যাবে নাকি? যেভাবে মাফ চাইছ।’ দিপু জোরে হেসে উঠল।
‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট। তুমি বুঝবে না,’ হতাশামাখা কণ্ঠ নিরুপমার।
দিপু নিরুপমাকে শক্ত করে ধরে রইল। আজ সারারাত ওকে দিপু ভালবাসবে, ওর সবটুকু কষ্ট নিজের করে নেবে। ও বলল, ‘পিঠের সেই ক্ষতটা দেখতে চাই। আজ আমি লজ্জা পাব না। ঠিক আছে?’
এমন সময় বাথরুমের দরজায় মৃদু শব্দ হলো। দিপু চমকে উঠে লাইট জ্বালল। আশ্চর্য ব্যাপার, বাথরুমের দরজায় তালা নেই। শুধু একটা ছিটকিনি দেয়া। দিপু নিরুপমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আবার এই বাথরুমের তালা খুলেছ?’