এত আবেগ, ভালবাসার জবাবে ওর কী বলা উচিত জানে না, এক শব্দে বলল, ‘থাকব।’
‘আমাকে ভালবাসো তো?’ অনুনয়ের সঙ্গে বলল নিরুপমা।
‘হ্যাঁ। ভালবাসি। ভালবাসি। ভালবাসি।’ আহা! কথাটা বলতে কতই না ভাল লাগছে দিপুর। মনে হচ্ছে ক্রমাগত ভালবাসি-ভালবাসি বলতেই থাকে।
এরপর হুট করেই নিরুপমা দিপুকে জড়িয়ে ধরল। হু-হু করে কেঁদে ফেলল। ‘আমাকে ফেলে যেয়ো না, দিপু। আমার সব বিপদে পাশে থেকো।’ দিপুও সুযোগটা হাতছাড়া করল না। নিরুপমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল। মনে হচ্ছিল সে এই পৃথিবীতে নেই। কেন জানি মনে হচ্ছে এটা কোনও স্বপ্নদৃশ্য।
তিন
নিরুপমা ফোন করে ওদের বাসায় যেতে বলল দিপুকে। আজ অন্য পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সব বাদ দিয়ে সেলিম চাচাদের বাসার দিকে রওনা দিল দিপু।
নিরুপমাকে আজ খুব খুশি-খুশি লাগছে। দিপুকে সরাসরি নিজের বেডরুমে নিয়ে গেল। সেলিম চাচা আর নিগার চাচী বিষয়টা নিয়ে কিছু মনে করবেন কি না, এই ভয় হচ্ছিল ওর। কিন্তু নিরুপমার মধ্যে কোনও ভ্রুক্ষেপ লক্ষ করল না। নিরুপমা ওখানেই থেমে থাকল না। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দিপু লাফিয়ে উঠে বলল, ‘দরজা বন্ধ করছ কেন?’
‘হা-হা। ভয় পাচ্ছ কেন, বোকা ছেলে? একটু আরাম করে গল্প করতে চাই তোমার সাথে, এর বেশি কিছু না।’
‘চাচা-চাচী যদি কিছু মনে করেন?’
‘বাবা-মা কিছুই মনে করবেন না, আমি তাঁদের সব খুলে বলেছি।’
‘বলো কী? কী সর্বনাশ!’
‘সর্বনাশের কিছু নেই। আমি তাঁদের বলেছি দ্রুত আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। তাঁরাও সম্ভবত মনে-মনে এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। তোমার বাবা- মা’র সাথে প্রাথমিক কথাও নাকি হয়ে গেছে।’
‘আম্মা-আব্বা তো আমাকে কিছু বলেননি!’ বিস্মিত গলায় বলল দিপু।
‘হয়তো কথা আর একটু এগোলে বলবেন।’
‘তুমি এত দ্রুত কীভাবে সব ম্যানেজ করলে?’
‘হা-হা। আমার কাছে জাদু আছে,’ রহস্যমাখা গলায় নিরুপমা বলল।
আজ দিপু নিজেই নিরুপমাকে আলিঙ্গন করল। নিরুপমা দিপুর গালে একটা চুমু এঁকে দিল। ওরা অনেক গল্প করল। ভবিষ্যৎ স্বপ্নের গল্প, ভালবাসার গল্প, গল্প যেন শেষই হয় না। নিরুপমা হঠাৎ লাজুক গলায় বলল, ‘তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে ইচ্ছা করছে।’
‘কী?’
‘সেদিন মেয়েটা পিঠের যে জায়গাটায় কামড় দিয়েছিল, সেই জায়গাটা।’ দিপুর শরীরের ভিতর দিয়ে আলোড়ন বয়ে গেল। এত সৌভাগ্য কি ওর হবে? দিপু মাথা নাড়ল। ‘হ্যাঁ। আমি দেখতে চাই।’
‘নাও। জামার পিছন দিকের বোতাম দুটো খোলো,’ নিরুপমা মাথা নিচু করে বলল।
দিপু লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল। এগোনোর সাহস পাচ্ছিল না। নিরুপমা হেসে বলল, ‘থাক। এত লজ্জা পেতে হবে না। এই বিষয়টা আমাদের বাসর রাতের জন্য তোলা রইল।’
চার
সবকিছু ভালই চলছিল। দ্রুত একটা ঘরোয়া আয়োজনের মধ্য দিয়ে নিরুপমা আর দিপুর বিয়ে হবে। কিন্তু দুঃস্বপ্নের মত আবার বাথরুমের সেই ঘটনাগুলো সামনে চলে এল। এখনও সেই ঘটনার রেশ নিরুপমাকে টানতে হচ্ছে। আজ সেলিম চাচাদের বাসায় ও আসার পর থেকেই নিরুপমা আকুল হয়ে কাঁদছে। দিপুর অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে, কী যে বিপদে পড়েছে মেয়েটা। সেলিম চাচা নিরুপমার ঘরের ওয়াশরুমে একটা বড় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাথরুমের সেই মেয়েটা প্রায়ই নিরুপমার স্বপ্নে দেখা দিচ্ছে। বারবার বলছে যে খুব তাড়াতাড়ি নিরুপমার জীবন শেষ করে দেবে। খুব কষ্ট দিয়ে মারবে নিরুপমাকে। তার অনেক দিনের খিদে। নিরুপমাকে দিয়ে তার খিদে মেটাবে।
সেলিম চাচা বাড়ি বদলের চিন্তা করছেন, কিন্তু নিরুপমা বলেছে বাড়ি বদলে কোনও কাজ হবে না। বরং বাড়ি বদলানোর চেষ্টা করলে মেয়েটা তখনই তাকে মেরে ফেলবে।
দিপুর মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ক্রোধের ভাব জেগে উঠল। নিরুপমাকে রক্ষা করতেই হবে। আগে এই বাসার বাথরুমের ইতিহাসটা জানা দরকার। দিপু সেলিম চাচার সঙ্গে কথা বলে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে গেল।
সেলিম চাচাদের বাড়িওয়ালা নবির শেখ বয়স্ক মানুষ। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। কথাবার্তা বলেন স্পষ্ট গলায়। তিনি দিপুকে দেখে কথা বলার তেমন কোনও আগ্রহ দেখালেন না। কেমন যেন সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। উঁচু গলায় বললেন, ‘আমি তো বাড়ি ভাড়া দেয়ার সময়েই বলেছিলাম ওই বাথরুমে কেউ ঢুকবেন না। আমার কথা শুনেছেন?’
দিপু চুপ করে রইল।
নবির শেখ আবার বললেন, ‘নিরুপমা মেয়েটা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সাহস খুব দরকারী একটা জিনিস। তবে মুরব্বীদের উপদেশ মেনে চলাও সমান দরকারী। ছোট ভুলের বড় শাস্তি পাবে মেয়েটা।’
দিপু জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এই বাথরুমের রহস্যটা কী?’
নবির শেখ উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। দিপু তাগাদা দিয়ে বলল, ‘আমাদের সবকিছু জানা প্রয়োজন। এর সাথে নিরুপমার জীবন-মরণ জড়িত।’
নবির শেখ দিপুর দিকে একটু ঝুঁকে বললেন, ‘আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে ওই বাথরুমে এলিনা নামে একটা মেয়ে মারা গিয়েছিল।’
‘কীভাবে মারা গিয়েছিল?’
‘তার স্বামী তাকে মেরে ফেলেছিল। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, সে মেয়েটার একটা হাতও কেটে ফেলেছিল। আর পুরো শরীরটা খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে বিকৃত করেছিল। পরে অবশ্য এলিনার স্বামীরও ফাঁসি হয়েছিল। তখন আমার বাবা বেঁচে ছিলেন। তিনি ওই বাথরুমটা তালাবদ্ধ করে রাখেন। তিনি দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন, এই বাথরুমটা ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। এখানে এলিনার আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই কাউকে বাড়ি ভাড়া দেয়ার আগে বাবা বলতেন, কোনওক্রমেই বাথরুমটা খোলা যাবে না। কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ খুব বেশি। তাই অনেক ভাড়াটিয়া আমাদের নিষেধ শোনেনি, তার ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। এ পর্যন্ত পাঁচজন ওই বাথরুমে মারা গেছে। প্রতিবারই থানা-পুলিশ হয়েছে। কিন্তু কাকে ধরবে পুলিশ, মৃত মানুষকে তো আর গ্রেফতার করা যায় না।’