‘কিন্তু কী?’
‘পানি অসম্ভব ময়লা ছিল। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পানির সাথে সাদা-সাদা ছোট টুকরো চলে এসেছে, চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সাদা টুকরোগুলো হাতে নিয়ে বুঝলাম, ওগুলো…’ নিরুপমা চোখ ঢেকে ফেলল।
‘ওগুলো কী ছিল?’
‘আমি বলতে পারব না। ওহ…আমি বলতে পারব না।’
‘প্লিজ, নিরুপমা, বলো।’
‘ওগুলো…ওগুলো…মাংসের টুকরো ছিল।’
‘ওহ, মাই গড। কী বলছ এসব?’
‘হ্যাঁ। আমার পুরো শরীর যেন ঘিনঘিন করে উঠল। মনে হলো পালিয়ে আসি সেখান থেকে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ পানির রং বদলে গেল। পানি ক্রমেই লাল হয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম ওগুলো পানি নয়, রক্ত। এতক্ষণ কি তা হলে রক্ত আর মাংস দিয়ে গোসল করেছি? শাওয়ার বন্ধ করলাম আমি। কিন্তু কোনও লাভ হলো না। আগের মতই চলতে লাগল। এমন সময় মনে হলো কমোডের মধ্য থেকে কেউ শব্দ করছে। প্রথমে মৃদুস্বরে, এরপর শব্দের গতি ক্রমেই তীব্র হলো। আমি ধীরে-ধীরে কমোডের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কাঁপা হাতে কমোডের ঢাকনা তুলেছিলাম। এরপর নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে ভয়ে আর্তচিৎকার দিয়েছিলাম।’ হু-হু করে কেঁদে উঠল নিরুপমা।
‘নিরুপমা, কেঁদো না। শক্ত হও। সবকিছু বলো আমাকে। কমোডের ঢাকনা উঠিয়ে কী দেখতে পেয়েছিলে?’
‘আমি দেখলাম কমোডের মধ্যে একটা কাটা হাত। কিন্তু হাতে একটাও আঙুল নেই। আমি আর দেরি করিনি। দৌড়ে দরজার কাছে চলে গিয়েছি। প্রবল শক্তিতে দরজা খোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আতঙ্কের সাথে লক্ষ করলাম, দরজা খুলতে পারছি না। মনে হচ্ছিল দ্রজা জ্যাম হয়ে গেছে। এমন সময় একটা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। তখন বিকালের আলো ভেন্টিলেটার দিয়ে পুরো ওয়াশরুমে ঢুকছিল। হঠাৎ আলোর পথে যেন এক রাশ অন্ধকার বাধা হয়ে এল। পুরো ওয়াশরুম ক্রমেই অন্ধকার হতে লাগল। পরিবেশটাও আশ্চর্য নীরব হয়ে উঠেছিল। শাওয়ারও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গোঙানির শব্দটা আবার শুনতে পেয়েছিলাম। আমি কাঁপতে-কাঁপতে বললাম, ‘কে-কে?’ কেউ একজন মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল। আমি শব্দের উৎস খোঁজার জন্য এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। কেন জানি মনে হচ্ছিল, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। হঠাৎ ওয়াশরুমের উপরের দিকে নজর গেল আমার। উপরের দৃশ্য দেখে আমি যেন পাথরের মত জমে গিয়েছিলাম।’
‘কী ছিল সেখানে?’ প্রশ্ন করল দিপু।
একজন, মানে একটা মেয়ে সেখানে ঝুলছিল। অনেকটা বাদুড়ের মত। তার একটা হাত নেই। বুঝতে পারলাম এই মেয়েটাই এতক্ষণ শব্দ করছিল। আমি চিৎকার করে উঠলাম। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে-যেতে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। মেয়েটি দেয়াল থেকে নীচে নেমে এল। এমন বিশ্রী চেহারার মানুষ আমি আগে কখনও দেখিনি। চোখের মণি সাদা রঙের, মাথায় একটাও চুল নেই, আর কালো জিভটা ক্রমাগত নড়াচড়া করছিল। আমি এক-এক পা করে পিছনে সরে যাচ্ছিলাম, মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ভয়ে আমি কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিলাম। তার চোখের দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল আমাকে যে-কোনও সময় মেরে ফেলবে। হঠাৎ মেয়েটা আমাকে জাপটে ধরল। আমি নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সে এক চুলও সরেনি। আমার পিঠে সে তার ধারাল দাঁত দিয়ে কামড় বসিয়ে দিল। মুহূর্তেই পুরো পৃথিবী আমার সামনে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। অঝোরে রক্ত ঝরছিল বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। আমি চিৎকার করে বলছিলাম, ‘ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও।’ আমার কথায় যেন ম্যাজিকের মত কাজ হয়েছিল। মেয়েটা আমাকে ছেড়ে দিল। এরপর কানের কাছে মুখ এনে কিছু কথা বলল। তারপর মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ওয়াশরুমে আবার আলো ফিরে এল। আমি দরজা আবার খোলার চেষ্টা করলাম। এবার দরজা খুলল। আমি বাইরে এসে বাবাকে ডাকলাম। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। সম্ভবত আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার দূরসম্পর্কের খালাতো বোন ডাক্তার। সে এসে আমার পিঠের ক্ষতে ড্রেসিং করে দিয়েছিল। এরপর বাবা ওয়াশরুমে একটা বড় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন।’
দিপু বলল, ‘সেই মেয়েটা তোমাকে কানে-কানে কী বলেছিল?’
‘না। না। আমি আর কিছু বলব না।’
নিরুপমা আর কিছু বলতে চাইল না। দিপু বুঝতে পারল এসব চিন্তা করতে কষ্ট হচ্ছে ওর। নিরুপমা আদুরে গলায় বলল, ‘তুমি আমার কাছে একটু আসবে?’ দিপু চেয়ার নিয়ে নিরুপমার বিছানার কাছে চলে গেল। নিরুপমা দিপুর হাতটা শক্ত করে ধরল। দিপুর পুরো শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। নিরুপমা আগে কখনও ওর হাত ধরেনি। নিরুপমা বিড়বিড় করে বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো?’
‘হ্যাঁ। বলো।’ দিপুর গলাটা কেমন যেন কেঁপে উঠল
কেন জানি আজই বলতে ইচ্ছা করছে। হয়তো এটা বলার উপযুক্ত সময় নয়। তবু আমি আজ বলব। দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে লালন করা কথাটা আজ বলব।’
‘বলো, কোনও সমস্যা নেই।’ দিপুর গলার কাছে কিছু একটা যেন আটকে গেছে।
‘আমি তোমাকে ভালবাসি। অনেক ভালবাসি
দিপুর মনে হলো সে ভুল শুনছে। যে কথাটা সে বহুদিন ধরে বলার চেষ্টা করছিল, সেটা নিরুপমা এত সহজে বলে দিল! দিপু স্বপ্ন দেখছে না তো? নিরুপমা এখনও ওর হাত শক্ত করে ধরে আছে। ধীরে-ধীরে বিছানায় উঠে বসল। এরপর বলল, ‘তুমি কি আমার পাশে থাকবে, দিপু?’