নতুন বাসায় সবকিছু দ্রুত গুছিয়ে নিলেন নিগার চাচী। তাঁর কর্মদক্ষতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। একাই একশো। দিপুর আম্মুও অবশ্য যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন।
সকালে অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে দিপু, সেই মুহূর্তে সেলিম চাচার ফোন। এত সকালে ওনার ফোন পেয়ে বেশ অবাকই হলো ও। সেলিম চাচা বললেন, ‘দিপু, আজ অফিস শেষ করে আমাদের বাসায় একটু আসতে পারবে?’
দিপু বলল, ‘হ্যাঁ, চাচা। অবশ্যই আসতে পারব।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। চলে এসো।’
‘চাচা, কোনও সমস্যা?’
‘তেমন কিছু না। সামনাসামনি বলব।’ বলেই ফোনটা রেখে দিলেন। দিপু চিন্তায় পড়ল। সারাদিন অফিসে অস্বস্তিতে কাটাল। অফিস শেষ করে এক মুহূর্ত দেরি না করে সেলিম চাচাদের বাসার দিকে রওনা দিল
আজ সেলিম চাচাকে অনেক গম্ভীর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। দিপুর মনের ভিতর ভয়ের অনুভূতি দানা বাঁধছে। সে কি কোনও ভুল করেছে? দিপু প্রায় পনেরো মিনিট বসে আছে, এর মধ্যে সেলিম চাচা ওর সঙ্গে একটা কথাও বলেননি। তাঁর সামনে চায়ের কাপ, কিন্তু একবার চুমুকও দেননি। তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন, মনে হচ্ছে আনমনে কিছু ভাবছেন।
অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই সেলিম চাচা বললেন, ‘দিপু।’
‘জী, চাচা।’ হঠাৎ শব্দ শুনে কিছুটা চমকে উঠল দিপু।
‘তোমার সাথে কি নিরুপমার নিয়মিত কথা হয়?’
প্রশ্নটা দিপুর কাছে পরিষ্কার নয়। তাই আমতা-আমতা করল। বলল, ‘জী…মানে…’
কেন জানি গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। পানি খাওয়া দরকার। নিরুপমার সঙ্গে কথা বলা নিয়ে কি কোনও ঝামেলা হয়েছে? নিরুপমা কি ওর কোনও আচরণে রাগ করেছে? মাথার ভিতর রাজ্যের সব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
চাচা আবার বললেন, ‘আমার যতদূর মনে হয়, নিরুপমা আর তুমি খুব ভাল বন্ধু। তাই তোমাকে ডেকেছি। আর তুমি তো এ বাড়িরই ছেলে।’
কথাটা শুনে দিপুর ভয়ের ভাবটা কিছুটা কাটল। ‘এ বাড়ির ছেলে’ কথাটা মধুর মত শোনাল।
সেলিম চাচা আবার বললেন, ‘নিরুপমাকে নিয়ে একটু ঝামেলায় পড়েছি। তোমার সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাই।’
‘কী সমস্যা, চাচা?’
‘নিরুপমা যে রুমে থাকে, সেই রুমে একটা অ্যাটাচড বাথরুম রয়েছে। সেটাতে বিশাল বড় একটা তালা ছিল। বাড়িওয়ালা প্রথম দিনেই বলেছিলেন, ‘এই বাথরুমে কোনওক্রমেই ঢোকা যাবে না।’ নিরুপমা হেসে বলেছিল, ‘কেন, চাচা? ভূত আছে নাকি?’ বাড়িওয়ালা কথাটা ভালভাবে নেননি। রাগতস্বরে বলেছিলেন, ‘মা, এ নিয়ে আর কোনও কথা বলতে চাই না। খবরদার, এই বাথরুমে কাউকে ঢুকতে দেবে না।’ আমার মেয়েটা একটু জেদি ধরনের, জানো তো। ওর মধ্যে জেদ চেপে গেল। বাড়িওয়ালা চলে যাওয়ার পর সে চেঁচিয়ে বলল, ‘এইসব কুসংস্কারের জন্য দেশ এখনও পিছিয়ে আছে। আরে, ওয়াশরুম নিয়ে এত ভয়ের কী আছে? আমি এই তালা ভাঙব। নিজের রুমে ওয়াশরুম থাকতে অন্য রুমে যেতে পারব না।’ আমি বললাম, ‘মা, বাড়িওয়ালা যখন নিষেধ করেছেন, তখন থাক না। আরও দুইটা বাথরুম আছে তো।’ নিরুপমা বলল, ‘না, বাবা। আমি এই ওয়াশরুমই ইউজ করব।’ ও তালাটা ভেঙে ফেলল। ঝকঝকে-তকতকে একটা বাথরুম। দেখে মনেই হয় না যে দীর্ঘদিন কেউ এটা ব্যবহার করেনি। পরিষ্কার করার প্রয়োজন ছিল না, তবু বাথরুমটা আবার পরিষ্কার করল নিরুপমা। নতুন লাইটও লাগাল। কয়েকদিন পেরিয়ে গেল। আমি বিষয়টা এত বেশি গুরুত্ব দিইনি। গত পরশু রাতে নিরুপমা বাথরুমে যাওয়ার পর ভয়াবহ কিছু কাণ্ড ঘটেছে।’
দিপু আঁতকে উঠে বলল, ‘কী হয়েছে, চাচা?’
‘কী ঘটেছিল নিরুপমা আমাদের সব বলেছে। তবে আমি চাই তুমি আবার ওর মুখ থেকে সব শোনো। পারলে আমার মেয়েটাকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো, বাবা। যাও, নিরুপমা রুমেই আছে।’
নিরুপমা তার রুমে শুয়ে ছিল। দিপু দরজায় নক করল। অনুমতি চাইল, ‘আসব?’
নিরুপমা বলল, ‘এসো, দিপু।’
দিপু ওর বিছানার পাশের চেয়ারে বসল। হাসিমুখে বলল, ‘কেমন আছ? অসুস্থ নাকি?’
‘হ্যাঁ। আমি অসুস্থ।’ নিরুপমার চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। জবুথুবু হয়ে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে শীত লাগছে তার।
দিপু কৌতুকের সুরে বলল, ‘চাচা বললেন, তুমি নাকি বাথরুমে গিয়ে ভয় পেয়েছ?’
‘তুমি মজা পাচ্ছ?’ আহত গলায় নিরুপমার প্রশ্ন।
দিপু যেন সংবিৎ ফিরে পেল। মাথাটা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে বলল, ‘না। না। আমি মজা করে কিছু বলিনি। আসলে পরিস্থিতিটা হালকা করার জন্য এমন সুরে কথা বলছিলাম। সরি।’
নিরুপমা চোখ বন্ধ করল। মনে হলো, তাকিয়ে থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে। দিপুর নজর গেল বাথরুমটার দিকে। সেটার দরজায় একটা নতুন তালা ঝুলছে।
দিপু নিচু গলায় বলল, ‘আমাকে সবকিছু বলবে, প্লিজ?’
নিরুপমা চাদরটা ভালভাবে শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘বলব। তোমাকে যে সব বলতেই হবে।’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘সেদিন ওয়াশরুমে ঢোকার পর কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল, অনুভব করছিলাম কিছু একটা ঠিক নেই। বেসিনের আয়নার দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল। অজানা ভয় তখন আমাকে জেঁকে ধরেছিল, মনে হচ্ছিল আয়নার দিকে তাকিয়ে অন্য কারও মুখ দেখতে পাব। নাহ, তেমন কিছু ঘটেনি। আয়নার মধ্যে আমার মুখই দেখেছিলাম। এরপর শাওয়ার চালু করেছিলাম। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছিলাম। তাই ঠাণ্ডা পানিতে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছিল। কিছু সময় পার হওয়ার পর, আমার অস্বস্তিটা বাড়ল। মনে হলো, কেউ আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চমকে পিছনে তাকালাম, কিন্তু পিছনে কেউ ছিল না। শাওয়ারের দিকে নজর গেল আমার। পানির বেগ ঠিকই ছিল। কিন্তু…’