নীচতলায় অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। পাশের ঘরেও কেউ যেন বিচিত্র স্বরে কথা বলছে। রুদ্রর আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না।
এমন সময় ইলিয়াস ঘরে এসে ঢুকল। রুদ্র নিলয়ের ছবিটা বালিশের নীচে লুকিয়ে ফেলল।
রুদ্র স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ইলিয়াস, বাসা থেকে ফোন এসেছিল। আব্বার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়েছে। আমাকে যেতে হবে।’
ইলিয়াস চিন্তিত গলায় বলল, ‘তাই নাকি! ঠিক আছে, তুই চলে যা।’
রুদ্র উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মাথাটা ঘুরে উঠল। পেটের মধ্যেও কেমন যেন পাক দিচ্ছে। ইলিয়াসের চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে। সে মুখে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘তুই নিলয়ের ছবিটা দেখে ফেলেছিস, না?’
রুদ্র ভয়ে ভয়ে ইলিয়াসের দিকে তাকাল।
ইলিয়াস ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আসগরেরও একটা ছবি আছে। দেখিসনি?’
রুদ্রর শরীর কেমন অবশ হয়ে গেল। আসগরও ওদের সঙ্গে পড়ত। পাঁচ-ছয় মাস আগে সে-ও নিখোঁজ হয়।
ইলিয়াস বলল, ‘চল, তোকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’
রুদ্র হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
ইলিয়াস জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, ‘দাদি কী সব জুস যে বানায়, সবার শুধু মাথা ঘোরে। দাদি, ভাল জুস বানাতে পারো না?’
হঠাৎ এক বৃদ্ধা মহিলার কণ্ঠ শুনতে পেল রুদ্র। জড়ানো কণ্ঠস্বর, শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ‘ঠিক আছে। এখন থেকে ভাল করে জুস বানাব। ভয়ঙ্করভাবে হেসে উঠলেন বৃদ্ধা। ইলিয়াস হাসিতে যোগ দিল। রুদ্র আরও বেশ কয়েকজনের হাসির শব্দ শুনতে পেল। সে জেগে থাকার অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে এল।
তিন
কেউ একজন অনেক দূর থেকে রুদ্রকে ডাকছে। ও চোখ মেলে তাকাল। আলোতে পরিপূর্ণ একটা ঘর। রুদ্রর পুরো শরীর নগ্ন। হাত-পা শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা। মুখে টেপ লাগানো। ওর সামনে উদ্বিগ্ন মুখে ইলিয়াস বসে আছে।
ইলিয়াস বলল, ‘দাদির জুসের প্রভাব চার-পাঁচ ঘণ্টা থাকে। এরপর ঘুম ভেঙে যায়। এখন কেমন লাগছে?’
রুদ্র নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু দড়িগুলো এতটুকু আলগা হলো না।
ইলিয়াস উপরের দিকে হাত তুলে জোরে বলল, ‘অনেক খিদে আমাদের। ক্ষুধার্তদেরকে তাদের কাজ করতে দে। নড়াচড়া করিস না।’
রুদ্র দেখতে পেল পনেরো-ষোলোটা টিকটিকি দেয়াল বেয়ে তার শরীরে বসেছে। ধীরে-ধীরে ওগুলোর আকার বহুগুণে বেড়ে গেল। রুদ্র ইলিয়াসকে আর দেখতে পেল না। সে-ও বড়সড় একটা টিকটিকি হয়ে গেছে। রুদ্র ছোট একটা বাচ্চার কণ্ঠ শুনতে পেল। ‘বাবা, চোখটা আমি খাই?’
‘খাও। আরাম করে খাও, বাবা।
বাচ্চা টিকটিকিটা আরাম করে রুদ্রর চোখ খেতে লাগল। চোখ হারানোর পরেও রুদ্র ভাসা-ভাসা অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে। সে দেখতে পেল টিকটিকিগুলো তার সমস্ত শরীর খুবলে খুবলে খাচ্ছে। তার কেন জানি মনে হতে লাগল এটা একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। একটু পরেই সে ঘুম থেকে জেগে উঠবে। দেখবে সে তার ঘরের খাটে শুয়ে আছে। সকালের রোদ তার পায়ে এসে পড়েছে।
রুদ্রর এই ভাবনায় ছেদ পড়ল। একটা টিকটিকি জোরে ডেকে উঠল, ‘টিক-টিক-টিক।’
দরজার ওপাশে
এক
সেলিম চাচাদের বাসায় দিপু খুব একটা যেতে চায় না। এর পিছনে মূল কারণটা একটু জটিল। সহজ করে বলা যায়, সেলিম চাচার মেয়ে নিরুপমার প্রতি ওর প্রচণ্ড দুর্বলতা রয়েছে। প্রেমে পড়লে মানুষের আচার-আচরণ চোরের মত হয়ে যায়। ওর অবস্থাও সেরকম। শুধু মনে হয়, বারবার সেলিম চাচাদের বাসায় গেলে সবাই আসল ঘটনা বুঝে ফেলবে। তবে ওদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠলে আশা করা যায় দুই পরিবারের কেউই কোনও আপত্তি করবে না। কিন্তু দিপুর মূল দুশ্চিন্তাটা নিরুপমাকে নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই নিরুপমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। এখন প্রিয় বন্ধুকে কি নিরুপমা ভালবাসতে পারবে?
স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ে নিরুপমার প্রতি বিশেষ কোনও দুর্বলতা অনুভব করেনি। কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেণ্ড ইয়ারে উঠল, তখন কীভাবে যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। সেদিনটার কথা খুব মনে পড়ে, যেদিন নিরুপমাকে প্রথম শাড়ি পরতে দেখেছিল, নীল রঙের জামদানি শাড়ি। একটা নীল রঙের টিপও ছিল কপালে। ব্যস, এটুকুই, আর কোনও সাজসজ্জা ছিল না। তাতেই মনে হচ্ছিল দিপুর সামনে একটা নীল পরী বসে আছে, যার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতে হয়। সেদিন প্রথমবারের মত নিরুপমার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিল ও। ওর চোখের দিকেও তাকাতে পারছিল না, মনে হচ্ছিল হুট করেই ও অনেক বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
অনার্স শেষ করেই একটা ব্যাংকে চাকরি শুরু করেছে দিপু। এত দ্রুত চাকরি শুরুর কারণ হচ্ছে, নিরুপমাকে মনের সব কথা খুব দ্রুত খুলে বলতে চায়। তারপর আপন করে পেতে চায়।
সেলিম চাচা দিপুর আপন চাচা নন। দিপুর বাবার মামাতো ভাই। কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি গভীর। দিপুর জীবনের একটা বড় অংশ সেলিম চাচা আর নিগার চাচীর ভালবাসায় পরিপূর্ণ হয়েছে। চাচা সারাজীবন প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরি করেছেন, কিন্তু জীবনে কখনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তাই ঢাকা শহরে নিজের বাড়ি করা হয়নি। এখনও তাঁকে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে হয়। সাভারে অবশ্য তিন কাঠা জমি কিনেছেন, তবে কবে বাড়ি বানানোর সুযোগ হবে, এখনও জানেন না।
দুই
সেলিম চাচারা নতুন বাসায় উঠেছেন। আগের বাসাটার সবকিছু ভাল ছিল, কিন্তু পানি ঠিকমত পাওয়া যেত না। অগত্যা নতুন বাসা খুঁজতে হলো। নতুন বাসাটা পাঁচতলা, তিনতলায় থাকবেন সেলিম চাচা। নতুন বাসাটা আগের বাসার থেকে অনেক সুন্দর। সম্প্রতি বাড়িতে নতুন রং করা হয়েছে এবং সব রুমে নতুন টাইলস দেয়া হয়েছে। তিনতলাটা দীর্ঘদিন ফাঁকা পড়ে ছিল। তাই বাড়িওয়ালা সবকিছু নতুন করে সংস্কার করেছেন। দিপু, ওর আব্বু, আম্মু চাচাদের বাড়ি বদলের সময় যথাসাধ্য সাহায্য করল। দিপুর নজর অবশ্য নিরুপমার দিকেই বেশি ছিল। কে জানে নিরুপমা হয়তো ওর দুর্বলতা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। আজকাল প্রায়ই ফোনে কথা হয় ওদের। ফেসবুকে মেসেজও আদান- প্রদান হয় অনেক। দিপু মাঝে-মাঝে ইঙ্গিতে ওর ভাল লাগার কথা বোঝানোর চেষ্টা করে। নিরুপমা বুঝতে পারে কি না, কে জানে।