.
মোবাইলটা বাজছে। আমি চোখ মেলে তাকালাম। শরীরের কোথাও ব্যথা অনুভূত হচ্ছে না। মুখের মধ্যে দাঁতগুলো ঠিকমত আছে। হাত-পায়েও কোনও ক্ষত নেই।
আমি ফোন ধরলাম। মায়ের ফোন। মা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘কী রে, কী অবস্থা তোর? গতকাল থেকে তোকে ফোন করছি। ফোন ধরিস না কেন?’
আমার মনে পড়ে গেল। মা-বাবা নড়াইলে গেছেন। আমি বাসায় একা। মোবাইলের দিকে ভাল করে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। মোবাইলে তারিখ দেখাচ্ছে ৮ এপ্রিল। রাত নয়টা। আমি গতকাল রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়েছি। তার মানে আমার জীবন থেকে তেইশ ঘণ্টা হারিয়ে গেছে। আচ্ছা, রূপা কী করছে এখন? আমি আসলে খুব স্বার্থপর। মেয়েটাকে একা-একা ওই অন্ধকার জগতে রেখে এসেছি। সে হয়তো চিরতরে আটকা পড়ে গেছে ওখানে। খুব কষ্ট হতে লাগল আমার। ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
আমি গ্যারাজ থেকে আমাদের গাড়িটা বের করলাম। যদিও বের করতে একটু ভয়-ভয় করছে। কারণ, কয়েকদিন আগেই এই গাড়িতে আমার একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি সেটা মনে করতে চাই না। সব দুঃস্বপ্ন আমি ভুলে যেতে চাই।
একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে প্রিয় নান আর মুরগির গ্রিল খেয়ে নিলাম। রাতে বাসায় ফিরে আর ঘুমানোর সাহস করলাম না। পরদিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে তুমুল আড্ডায় মেতে উঠলাম। যা দেখছি তা-ই ভাল লাগছে। তবে মনের ভিতর কোথায় যেন একটা ভয়। অস্বস্তি দানা বাঁধছে। রাতেও আমার ঘুমাতে খুব ভয় লাগছিল। যদি আবার ওই জগতে ফিরে যাই? কিন্তু একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। স্বপ্নে রূপা আর আমি নৌকায় করে কোথায় যেন যাচ্ছি। আমার কোলে একটা ছোট বাচ্চা। রূপা বলল, ‘অ্যাই, নদীতে খুব স্রোত। বাবুকে সাবধানে রেখো।’
‘আচ্ছা।’
রূপা আবার বলল, ‘না, না। তুমি ওকে ফেলে দেবে। ওকে আমার কাছে দাও।’
রূপা আমার দিকে এগিয়ে এল। প্রচণ্ড স্রোতে নৌকাটা দুলছে। হঠাৎ তাল সামলাতে না পেরে নদীর মধ্যে পড়ে গেল রূপা। কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর ডুবে গেল।
আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ের অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। একটু পরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আনমনে পত্রিকাটা হাতে নিলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব সংবাদ পড়তে লাগলাম। হঠাৎ শেষ পৃষ্ঠায় ছোট একটা নিউজে আমার চোখ আটকে গেল।
নিউজটার শিরোনাম: ‘৭২ ঘণ্টা কোমায় থেকে মৃত্যুবরণ করলেন রূপা।’ ভিতরে লেখা: ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত রূপা মৃত্যুবরণ করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় চিকিৎসকরা তাঁর মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করেন। উল্লেখ্য, গত ৫ এপ্রিল উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় মারাত্মকভাবে আহত হন মেধাবী এ ছাত্রী। এ ব্যাপারে থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের হয়েছে।’
আমার হাত থেকে পত্রিকাটি পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল আমার সেই অন্যায়টির কথা। গত ৫ এপ্রিল আমি এলোপাথাড়ি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে এসে আমার গাড়ি একটা মেয়েকে ধাক্কা দেয়। আমি প্রাণভয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দ্রুত সরে পড়ি। ওই মেয়েটিই যে রূপা ছিল তা এখন বুঝতে পারছি।
রূপার প্রতি আমি দু’বার অন্যায় করেছি। একবার এই জগতে। একবার ওই অন্ধকার জগতে। এই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে।
.
অনেক রাত। আমি মনেপ্রাণে সেই অন্ধকার জগতে প্রবেশ করতে চাইছি। একাগ্রচিত্তে ওখানে যাওয়ার চেষ্টা করছি আমি। পথনির্দেশক বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘যারা অন্ধকার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফিরে যায়, তারা আবার চেষ্টা করলে অন্ধকার জগতে ফিরে আসতে পারে।
আমি সেই চেষ্টাই করছি। আমি ওই জগতেই স্থায়ীভাবে থাকতে চাই। এ-ও জানি, বাহাত্তর ঘণ্টা পেরোলেই বাস্তব জগতে মৃত্যু ঘটবে আমার। ভাবতে-ভাবতে চোখে এল রাজ্যের ঘুম।
আমি চোখ মেলে তাকালাম। আবার সেই তীব্র অন্ধকার। আমি তা হলে আবার সেই জগতে ফিরে এসেছি। তীব্র অন্ধকারেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। রূপাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমি ওর সঙ্গে চিরকাল থাকতে এ জগতে এসেছি। বলে উঠলাম, ‘রূপা…কোথায় তুমি?’
কেউ জবাব দিল না।
আমি আকুল হয়ে ডাকতেই লাগলাম, ‘রূপা…রূপা…’
টিক-টিক-টিক
এক
কলেজ কমপাউণ্ডে জারুল গাছটার নীচে বসে আছে ইলিয়াস। কেমন অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। ইলিয়াসের খুব কাছের বন্ধু রুদ্র। ইলিয়াসের মন খারাপ দেখলে তার নিজের মনটাও উদাস হয়ে যায়।
‘মনটা খারাপ কেন, ইলিয়াস?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘কয়েকদিন ধরে বাসায় একা আছি। তাই ভাল লাগছে না,’ রুদ্রর দিকে না তাকিয়েই বলল ইলিয়াস।
‘একা কেন? তোরা না যৌথ পরিবার? আর সবাই কোথায়?’ বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল রুদ্র।
‘সবাই গ্রামে গেছে।’
‘তুই গেলি না কেন?’
‘সামনে টেস্ট পরীক্ষা। এ অবস্থায় কীভাবে যাব?’ ইলিয়াসের গলায় সামান্য ক্ষোভের প্রকাশ।
‘খাওয়া-দাওয়া কীভাবে করছিস?’
‘বুয়া আছে। সে সকালে এসে রান্না করে দিয়ে যায়।’
‘হঠাৎ পুরো পরিবার গ্রামে গেল?’
‘গ্রামে জমি-জমা নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে।’
‘তোদের বাসা তো কল্যাণপুরে, না?’
‘নাহ, এখন মালিবাগে থাকি। আমাদের এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে ভাল লাগে না,’ ইলিয়াসের গলায় রহস্যের সুর।
‘তোরা পারিসও। প্রায় ষোলোজন মানুষ পরিবারে। এত মালপত্র নিয়ে বাসা বদলানো কি চাট্টিখানি কথা!’ একটু বিরতি দিয়ে রুদ্র বলল, ‘গত বছর কল্যাণপুরে তোদের বাসায় গিয়েছিলাম। মনে আছে?’