অন্ধকার জগতে সময় বলে কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব জগতে তো আছে, আমি বাস্তব জগতের সময়ের কথা বলছি।’
‘বাস্তব জগতের কোন্ সময়ের মধ্যে আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে?’
তোমার হাতে এখনও যথেষ্ট সময় থাকলেও মেয়েটির খুব বেশি সময় নেই। মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে এখান থেকে বেরোতে হবে।’
রূপা ভয়ঙ্কর চমকে উঠল
আমি বললাম, ‘কেউ কি এই অন্ধকার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফেরত গেছে?’
‘হ্যাঁ, কতজনই তো ফিরে যায়।’
‘আচ্ছা। কেউ বাস্তব জগতে গিয়ে কি আবার অন্ধকার জগতে ফিরে আসতে পারে?
‘যে মানুষ একবার অন্ধকার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে যায়, সে মনেপ্রাণে চাইলে আবার অন্ধকার জগতে ফিরে আসতে পারে। তখন তাকে আবার পথ খুঁজে বেরিয়ে যেতে হবে।’
‘এবার আপনি আমাদের বেরোনোর পথ বলে দিন।’
‘তোমরা সোজা. আর একটু হাঁটলেই একটা ফাঁকা জায়গা পাবে। সেখান থেকে ডান দিকে যেতে থাকবে। এরপর একটা ছোট খাল পাবে। খালে পানি খুব কম। খাল পেরিয়ে আবার সোজা এগোতে থাকবে। দেখবে নদীর ঘাটে পৌঁছে গেছ। সেখানে এক মাঝিকে পাবে। তাকে রাজি করিয়ে তোমাদের ওপারে যেতে হবে। ওপারে যাওয়ার পর টানা হেঁটে যেতে হবে সোজা। খুব বেশিক্ষণ নয়। দুই-তিন ঘণ্টা। কিন্তু মানুষ হাঁটতে পারে না। ওই পথ জুড়ে হাজার-হাজার কাঁটা রয়েছে। অনেকেই ওই পথে কিছুটা গিয়েই বসে পড়ে। দেরি করে ফেলে। কেউ উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে। কেউ ভুল পথে চলে যায়। কেউ ব্যথায়, যন্ত্রণায় ঘোরের মধ্যে চলে যায়। এদিকে সময় শেষ হয়ে যায়। চিরতরে আটকা পড়ে যায় সে।’
বৃদ্ধ পথনির্দেশক একটু থামলেন। আবার বললেন, ‘তোমরা যদি ঠিক পথে এগোতে থাকো তবে একসময় তীব্র আলোর রেখা দেখতে পাবে। সেই আলোর দিকে কিছুক্ষণ এগোলেই তোমরা বাস্তব জগতে চলে যাবে।’
‘ধন্যবাদ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাহায্য করার জন্য। আমরা এখনই এগোতে চাই।’
‘হ্যাঁ, যাও।’
আমরা এগোতে লাগলাম। ওই পথনির্দেশক বৃদ্ধ সাহায্য না করলে হয়তো গোলকধাঁধায় আটকা পড়তাম। হয়তো এক জায়গাতেই ঘোরাঘুরি করতাম। রূপা এখন আমার আরও কাছে। এত কাছে যে ওর নিঃশ্বাসের উষ্ণতা শরীরে অনুভব করছি। বাস্তব জগতে এমন হত কি না জানি না। তবে এখানে খুব সহজেই কথাটা বলে ফেললাম রূপাকে
‘রূপা, আমরা যদি ফিরে যেতে পারি, তবে…’
‘তবে কী?’
‘তুমি-আমি চিরকাল পাশাপাশি থাকব।’
‘হ্যাঁ, তুমি-আমি…. চিরকাল…একসাথে।’
ভালবাসায় আমার হৃদয়টা আর্দ্র হলো। মনে হলো সব ভয়কে জয় করা সময়ের ব্যাপার। আমরা নদীর ঘাটে পৌঁছলাম। নদীতে তীব্র স্রোত। নদীর দিকে তাকাতেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। পাগলের মত মাঝিকে খুঁজতে লাগলাম। এমন সময় রূপা আমাকে বলল, ‘ওই যে, একটা নৌকা।’
অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। তবে নৌকা বলেই মনে হচ্ছে। আমরা নৌকায় ওঠার চেষ্টা করতেই নৌকার মাঝি বলল, ‘কে তোমরা? কী চাও?’
‘আমরা ওপারে যেতে চাই। আমাদের পার করে দিন।’
‘এখন পার করতে পারব না।’
‘দয়া করুন। আমাদের পার করে দিন।’
অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর মাঝি রাজি হলো। আমরা দু’জন নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকা চলতে শুরু করল। তীব্র স্রোতে দুলতে শুরু করল।
রূপা বলল, ‘নৌকা ডুবে যাচ্ছে… ডুবে যাচ্ছে। আমরা মারা যাব।’
মাঝি জবাব দিল, ‘না। নৌকা ডুববে না। আর এ জগতে কেউ মারা যায় না। তোমরা এখন চোখ বন্ধ করো। আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।’
‘কেন?’
‘এত কৌতূহল ভাল নয়। যা বলছি করো।’
আমরা চোখ বন্ধ করলাম। তখনই নৌকাটা আরও বিচিত্রভাবে দুলতে লাগল। চারদিকে নানান শব্দ শুনতে পেলাম। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ বিচিত্র ভাষায় কিছু বলছে। মাঝির কণ্ঠও শুনতে পেলাম: ‘যা-যা, দূর হয়ে যা।’
কেউ বলল: ‘পার করে দে। আমাদের পার করে দে।’
‘যা-যা…নৌকায় উঠবি না। যা, দূর হ।’
‘পার করে দে…’ প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনতে পেলাম। সে আর্তনাদ আকাশ- বাতাস ভেদ করে চলে গেল।
রূপা ফিসফিস করে বলল, ‘আমরা কি ফিরতে পারব? এখান থেকে মুক্তি পাব?’
‘নিশ্চয়ই মুক্তি পাব, রূপা, নিশ্চয়ই।’
যতবার রূপাকে আশ্বাস দিলাম ততবারই বুকের ভিতরটা ওলটপালট হয়ে গেল আমার। কিছুক্ষণ পর মাঝি বলল, ‘চোখ খোলো।’
আমরা চোখ মেলে তাকালাম। মনে হলো নদীর এপারে পৌঁছে গেছি। মাঝি বলল, ‘যাও, নেমে পড়ো।’
আমি বললাম, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘তোমার ধন্যবাদ আমার প্রয়োজন নেই। তুমি পাপী, অন্যায়কারী। যাও, চলে যাও।‘
লোকটির কথা আমার মনে আঘাত করল। সে-ও আমার অন্যায়ের কথা জানে!
আমি আর রূপা এগোতে লাগলাম। একটু এগোতেই পায়ে কাঁটা ফুটতে শুরু করল। যন্ত্রণায় আঁতকে উঠলাম আমরা। দাঁতে দাঁত চেপে এগোতে লাগলাম। পা দিয়ে রক্ত ঝরছে অনবরত। রূপা বলে উঠল, ‘পারব না। আমি পারব না।’
‘পারতে হবে, রূপা। আমাদের পারতে হবে।’
আবার আমরা এগোনোর চেষ্টা করলাম। বারবার পড়ে যাচ্ছে রূপা। ওর শরীরের নানান জায়গায় কাঁটা ফুটে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে রূপা পড়ে গিয়ে বলে উঠল, ‘আমি আর এগোতে পারব না। কিছুতেই না।’ যন্ত্রণায় কাঁদতে লাগল একটানা।
‘চলো, রূপা। আমাকে ধরো। চেষ্টা করো।’
‘না, না, তুমি যাও। তুমি চলে যাও। আমি যাব না।’
‘রূপা, ওঠো….’
রূপা জবাব দিল না। হয়তো ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ রূপাকে ওঠানোর চেষ্টা করলাম। এরপর একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। রূপাকে ফেলেই আমি এগোব। দ্রুত এগোনোর জন্য আমি দৌড়াতে লাগলাম। ব্যথায় আমার পা অসাড় হয়ে গেল। তবু থামলাম না। পড়ে গেলাম বারবার। কিন্তু পরক্ষণেই আবার এগোতে লাগলাম। কতক্ষণ পেরিয়েছে জানি না। হঠাৎ তীব্র আলোর রেখা দেখতে পেলাম আমি। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আলোর দিকে আরও দ্রুত দৌড়াতে লাগলাম। নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হলো। মনে হচ্ছে বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া। পেটের ভিতরের সবকিছু মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবু আমি এগিয়ে চললাম। সবকিছু হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আবার তীব্র অন্ধকারে ডুবে গেলাম। তীব্র…তীব্র অন্ধকার।