এমন সময় কিছু একটা আমার মুখে আঘাত করল। প্রচণ্ড আঘাত। দুটো দাঁত ছিটকে বেরিয়ে এল। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। আমি পড়ে গেলাম।
মেয়েটি আবার চিৎকার করে বলল, ‘আমি মিথ্যা ঘৃণা করি। ঘৃণা… ঘৃণা!’
প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। ক্ষুধা, তৃষ্ণাও আগের থেকে বহুগুণ বেড়ে গেছে। কতক্ষণ পেরিয়েছে জানি না। দু’ঘণ্টা? পাঁচ ঘণ্টা? নাকি অনন্ত সময়? আমি আবার উঠলাম। হাঁটতে শুরু করলাম। মুখের ব্যথা ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। এমন সময় একটা মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি ভয়ে- ভয়ে বললাম, ‘কে?’
একটু সামনেই এক তরুণী মেয়েকে দেখতে পেলাম। এখানে যাদের সাথে আমার দেখা হয়েছে, কারও মুখই আমি দেখতে পাইনি। তবে আবছা আলোতে এই মেয়েটির মুখ দেখতে পাচ্ছি। অন্ধকারটা বেশ চোখে সয়ে গেছে। মেয়েটি আমাকে দেখে চমকে উঠল। বলল, ‘কে? কে আপনি?’
‘আমি? আমি নিয়াজ। আপনি কে?’
‘আমি রূপা। আপনি কীভাবে এলেন এখানে?’
‘আমি জানি না।’
‘আমিও বুঝতে পারছি না, কীভাবে এখানে এলাম।’
‘কতক্ষণ হলো আছেন এখানে?’
‘জানি না। সময় আন্দাজ করতে পারছি না। হয়তো একদিন, দু’দিন কিংবা আরও বেশি।’
‘এতদিন!! কোনও খাবার কি পেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, এখানে মাটিতে অনেক ধরনের ফল পড়ে আছে, সেগুলো খেয়েছি। সামনে একটা ডোবা আছে, সেখান থেকে পানি খেয়েছি।’ বলতে-বলতে রূপা কেঁদে উঠল। ‘আমি বাঁচতে চাই। ঘরে ফিরে যেতে চাই।’
আমি রূপার হাত ধরলাম। রূপার কান্না স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল।
আমি বললাম, ‘আপনার কি অতীতের সবকিছু মনে আছে? কোথায় থাকতেন আপনি?’
‘হ্যাঁ। সবকিছু মনে আছে। আমি উত্তরাতে থাকি।
‘আমারও সবকিছু মনে আছে। পরিবারের কথা, বন্ধুদের কথা।’
‘কী হবে এখন আমাদের?’
‘আমাদের নদী খুঁজে বের করতে হবে।’
‘তারপর?’
‘হয়তো নদী পেরোতে হবে আমাদের।’
‘আপনাকে কে বলেছে?’
‘আমি জেনেছি।’
‘আপনি মানুষ তো?’
এত বিপদের মধ্যেও আমি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ, রূপা, আমি মানুষ।
‘প্লিজ, আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না।’
‘না, যাব না। আমার নিজেরই খুব ভয় লাগছে! আপনাকে দেখে একটু হলেও মনে সাহস ফিরে পেয়েছি।’
‘আচ্ছা, এমন কি হতে পারে এটা মৃত্যুর পরের কোনও জগৎ?’
‘আমি ঠিক জানি না, রূপা। তবে সম্ভবত আমরা মারা যাইনি।’
‘তা হলে এটা কোন জায়গা?’
‘আমি ঠিক জানি না। হতে পারে এটা অন্ধকার জগৎ।’
‘অন্ধকার জগৎ?’ রূপার কণ্ঠে আতঙ্ক।
‘হ্যাঁ। তবে যে করেই হোক আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে।’
‘পারব আমরা?’
‘নিশ্চয়ই পারব।’ রূপাকে দেখে আমার মনোবল বহুগুণ বেড়ে গেছে। নারী যে প্রেরণাদায়ী তা এখানে এসেও টের পাচ্ছি।
আমরা এগোতে লাগলাম। রূপা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। বিচিত্র কোনও শব্দ শুনলেই আমাকে জড়িয়ে ধরছে। মনে হচ্ছে আমি যেন তার কত আপন। আমরা হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতেই লাগলাম। চেষ্টা করছি সোজা হাঁটতে। কিন্তু দিক ঠিক রাখা খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় মনে হলো কিছু একটা আমাদের অনুসরণ করছে। ভয়ে আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। চেঁচিয়ে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’
হঠাৎ একটা জন্তু আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জন্তুটাকে একবার কুকুর, একবার বাঘের মত লাগছে। জন্তুটা আমাকে ধারাল নখ দিয়ে আঁচড় দিতে লাগল। যেন আমার উপর ভয়ঙ্কর আক্রোশ রয়েছে। কামড় দিয়ে আমার শরীরটা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল জন্তুটা। রূপা কোথা থেকে একটা কাঠ জোগাড় করে জন্তুটাকে আঘাত করল। পালিয়ে গেল ওটা। আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। মনে হচ্ছে মারা যাব। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে চলেছি। রূপা কাঁদছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। ওর একটা হাত আমার মুখের উপর দিয়ে রেখেছে। বলল, ‘খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?’
এমন সময় কেউ একজন আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। এই লোকের মুখও দেখা যাচ্ছে না। তিনি কিছু পাতা আমার গায়ের উপর ফেললেন। রূপাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘পাতা থেকে রস বের করে ওর গায়ে লাগিয়ে দাও। ক্ষতগুলো ঠিক হয়ে যাবে।’
রূপা ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘কে আপনি?’
‘যা বলছি, আগে তাই করো।’
রূপা পাতাগুলো পিষে যতটুকু সম্ভব রস বের করল। এরপর আমার শরীরের ক্ষতস্থানগুলোতে লাগিয়ে দিল। একটু পরেই টের পেলাম ব্যথা কমে গেছে। উঠে বসলাম। বললাম, ‘আপনাকে ধন্যবাদ।’
‘তুমি অনেক বড় অন্যায় করেছ। এজন্য জন্তুটা তোমাকে আক্রমণ করেছে।’
‘কী অন্যায়?’
‘অন্যায়টা তুমি ভাল করেই জানো। দু’দিন আগে কি ঘটেছিল তোমার মনে নেই?’
আমি চমকে উঠলাম। মনে আছে। স্পষ্ট মনে আছে।
কাঁপা গলায় বললাম, ‘আপনি কে?’
‘আমি পথনির্দেশক বৃদ্ধ। আমি মানুষকে এখান থেকে বেরোনোর পথ বলে দিই।’
‘সত্যি! বলুন, কীভাবে আমরা বেরোব?’
‘বলব। নিশ্চয়ই বলব।’
‘আমি এখানে কতক্ষণ ধরে আছি?’
‘এখানে সময় বলে কিছু নেই।’
‘মানুষ এই জগতে আসে কীভাবে?’
‘ঘুমের ঘোরে, কোমায় থেকে, জ্ঞান হারিয়ে এ জগতে চলে আসতে পারে। আমরা যদি দুটো জগৎ ধরি-বাস্তব জগৎ এবং অন্ধকার জগৎ, তা হলে একজন মানুষকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে অন্ধকার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফিরে যেতে হয়। নতুবা সে চিরদিনের জন্য এ জগতে আটকা পড়ে যায়।’
‘আপনিই তো বললেন এখানে সময় বলে কিছু নেই। তা হলে কোন্ নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলছেন?’