সেজানকে দেখে রহমত আলী বলল, ‘কী, সেজান সাহেব, কেমন আছেন?’ তার কথা বলার ভঙ্গিতে আন্তরিকতা টের পাওয়া যায়। মধ্যবয়স্ক রহমত আলীর মুখ সদা হাস্যময়। সেই মুখে রাগ বা দুঃখের ছাপ সহজে ফুটে ওঠে না। মুখের বিশ্রী বসন্তের দাগ আর অস্বাভাবিক ছোট চোখ ধূর্ত ভাব নিয়ে এসেছে তার চেহারায়। তার দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকলে সেজানের কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে।
সেজান রহমত আলীর দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘জী, ভাল আছি।’
‘মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না, খুব ভাল আছেন।’ সবকিছু বুঝে ফেলেছেন এমনভাবে কথাগুলো বলল রহমত আলী।
‘আসলে একটা কথা জানার জন্য আপনার কাছে এসেছিলাম।’
‘বলুন।’
‘ইয়ে, মানে কাল রাতে আমাদের ইলেক্ট্রিসিটি লাইনে কিছু সমস্যা হয়েছিল। বাল্ব ফেটে গেছে। ফ্যানটা নীচে ভেঙে পড়েছে।’
‘বলেন কী! কালকে রাতে অবশ্য ভোল্টেজ আপ-ডাউন করেছে অনেকবার। আমাদের এই বাড়িতে কারেন্টের লাইনে বেশ সমস্যা আছে।’
‘কাল রাতে হঠাৎ ঝড় শুরু হলো, তখন…
সেজানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে বসল রহমত আলী, ‘আজব কথা! ঝড় আবার কখন হলো?’
‘না-না, ঠিক ঝড় না, ঝোড়ো বাতাস।’ নিজেকে সামলে নিয়ে কথাটা ঘুরিয়ে নিল সেজান।
‘ঝোড়ো বাতাস হয়েছে নাকি? টের পাইনি তো!’
‘আচ্ছা, আমি উঠি।’ চোখে-মুখে অনিশ্চয়তার ভাব নিয়ে উঠে পড়ল সেজান।
‘আরে, বসুন। চা খেয়ে যান। আপনার ভাবী অবশ্য ছেলেমেয়ে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়িতে গেছে। তাই আমাকেই চা বানাতে হবে।’
‘চা খাব না।’
‘বুঝতে পেরেছি। নতুন বিয়ে তো। ভাবীকে অল্প সময় না দেখলেই অস্থির লাগে, না?’ চোখ দিয়ে অশ্লীল এক ইঙ্গিত করল রহমত আলী।
‘না। বাসায় যাব না। অফিসে যেতে হবে।’
‘আরে, মিয়া, শুধু অফিস-অফিস করেন কেন! আসল অফিস তো বাড়িতেই। বউয়ের সাথে গুর মত সবসময় আটকে থাকবেন। হা-হা-হা!’ একতরফা হাসিটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল।
সেজান উঠে দাঁড়াল। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে তার।
.
রেহানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গতরাতের কথা কিছু মনে করতে পারছে না শুধু চাপা আতঙ্ক চেপে আছে তার বুকে। সকালে মিস্ত্রি ডেকে এনে ফ্যান লাগিয়েছে সেজান। নতুন বাল্বও লাগানো হয়েছে। যদি ফ্যানটা তাদের মাথার উপর ভেঙে পড়ত, তা হলে কী ভয়ঙ্কর কাণ্ডই না ঘটত। কেন এমন হচ্ছে, কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে রেহানা। ডায়রিতে সে তার জীবনের কিছু অন্যরকম ঘটনা লিখে রেখেছে। প্রায়ই ইচ্ছা হয় কেউ ডায়রিটা পড়ুক। রক্ষা করুক তাকে বিপদ থেকে। সেজানকেও বারবার কথাগুলো বলতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলা হয়নি। নিজের জীবনে ওকে জড়িয়ে মস্ত বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে বেচারা।
বারান্দা থেকে ফিরে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকল রেহানা। পানির স্পর্শটা খুব ভাল লাগল। গ্রামে থাকতে ছোটবেলায় প্রায়ই নদীতে সাঁতার কাটত। বাথরুমে চোখ বন্ধ করে সেই মজার দৃশ্যটা দেখতে চেষ্টা করল রেহানা। সে যেন ঢাকা শহরের বদ্ধ কোনও বাথরুমে নয়, বরং গ্রামের সেই নদীতে আছে।
ডোরবেল বেজে উঠল। একবার নয়, দু’বার নয়, পরপর তিনবার। রেহানা ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো পোশাক পরল। শরীরে ওড়না জড়ানোর বা চুলগুলো ভাল করে মোছার সময় পেল না। আবারও তিনবার বেজে উঠল ডোরবেল। দরজাটা অল্প একটু ফাঁক করে গলাটা বের করে বলল রেহানা, ‘কে?’
রহমত আলীকে দেখা গেল। হাসিমুখে সে রেহানার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাবী, আমি। দরজাটা খুলুন। আপনার ভাবী আমাকে পাঠিয়েছে। আপনার সাথে একটু দরকার আছে।’
রেহানা দরজা খুলবে কি না এক মুহূর্ত ভাবল। এরপর দরজা খুলে দিল। রহমত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি সোফাতে বসুন। আমি আসছি।’
‘ভাবী, একটু পরে যান। আমি বেশি সময় নেব না।’ রেহানার পুরো শরীরে ঘুরতে থাকে রহমত আলীর দৃষ্টি।
ভেজা চুল। এলোমেলো পোশাক। ফর্সা দেহ। উচ্ছল যৌবন।
নিজেকে যেন ধরে রাখতে পারল না রহমত আলী। ইচ্ছা করছে ঝাঁপিয়ে পড়তে মেয়েটার উপর। রহমত আলী বুঝে-শুনেই এই সময়ে এসেছে। সেজান বাসায় নেই। আর পাশাপাশি ফ্ল্যাট হওয়াতে কেউ গোসল করতে ঢুকলেই পাওয়া যায় পানির শব্দ। রহমত কান পেতে ছিল কখন বাথরুমে ঢুকবে রেহানা। অল্পবয়সী এই মেয়েটাকে গোসলের পরে দেখার দারুণ ইচ্ছা ছিল তার।
‘বলুন, কী বলবেন,’ মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল রেহানা।
‘কালকে রাতে আপনাদের ফ্যান ভেঙে পড়েছে শুনলাম। বাল্বও নাকি ফেটে গেছে। আপনি ঠিক আছেন কি না তা-ই দেখতে এলাম।’ কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়াল রহমত আলী।
রহমত আলীর দিকে তাকাল রেহানা। আস্তে-আস্তে ওর দিকে এগিয়ে আসছে রহমত আলী। সড়াৎ শব্দে টেনে নিল সে জিভের লালা। ‘ভাবী, আপনার তো এখন আনন্দের সময়। মজা আর উপভোগের সময়। আপনার জামাটা মনে হয় একটু টাইট হয়ে গেছে, না?’
রেহানা চমকে উঠল।
রহমত এখন তার আরও কাছে।
ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেল রেহানার। বলল, ‘আপনি আর কাছে আসবেন না।’
‘ভাবী, মনটা বড় করতে শিখুন। জীবনকে উপভোগ করতে শিখুন। আমার কিন্তু টাকার অভাব নেই।’
‘আর কাছে আসবেন না!’
তবু এগিয়ে যেতে লাগল রহমত। রেহানা মেয়েটাকে আজ সে কিছুতেই ছাড়বে না।
এমন সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। টায়ার পোড়া গন্ধে পুরো ঘর ভরে উঠল। কেউ যেন মুহূর্তেই শূন্যে তুলে নিল রহমতকে। এরপর ছুঁড়ে দিল দেয়ালের দিকে। প্রচণ্ড আঘাত লাগল রহমতের কাঁধে, পিঠে এবং কোমরে। ঘরে কী ঘটল বুঝতে পারল না রহমত। কোনওমতে উঠে দাঁড়াল। রেহানার শরীর সোফার উপর এলিয়ে পড়ে আছে। মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে ফেনা। মনে হচ্ছে জ্ঞান নেই। প্রচণ্ড ব্যথা অগ্রাহ্য করে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রহমত আলী। পুরো পৃথিবীটা দুলছে তার চোখের সামনে। সে বের হওয়ার সাথে-সাথে কেউ ধড়াম করে বন্ধ করে দিল রেহানাদের দরজাটা।
চার
দশ দিনের মাথায় ক্লিনিক থেকে রিলিজ করে দেয়া হলো আনোয়ারকে। এখন অনেকটাই সুস্থ সে। তবে আগামী এক মাস বাইরে বের হওয়া তার জন্য নিষেধ। এ ছাড়া, মশলা জাতীয় খাবার আপাতত হারাম। নিয়মিত পানি ফুটিয়ে খাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তার।