‘হেঁটে কোন্দিকে যাব?’
‘সেটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে।’
‘আপনি আমার সাথে থাকবেন?’
‘না।’
‘প্লিজ, আমাকে সাহায্য করুন।’
কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘সাহায্য করুন। আমাকে সাহায্য করুন। বাঁচাও, আমাকে কেউ বাঁচাও!’
কেউ সাড়া দিল না। আমি কাঁদতে লাগলাম। সর্বশেষ কবে কেঁদেছি মনে নেই। আর আজ ভয়ে-আতঙ্কে যেভাবে কাঁদছি, তার সঙ্গে অতীতের কোনও কান্নার মিল নেই।
ভয়! ভয়! ভয় আমাকে ক্রমাগত গ্রাস করছে। আমি বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি: ‘হে, মহান প্রতিপালক! সাহায্য করো। আমাকে রক্ষা করো।’
কিছুক্ষণ পর চারদিকে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। আস্তে-আস্তে চারদিক একটু পরিষ্কার হচ্ছে। আমি একটু আশ্বস্ত হলাম। আমি একটা ছোট খোলা জায়গায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে অসংখ্য গাছপালা। তা হলে আমি কি কোনও বনের মধ্যে আছি? আমি উঠে পড়লাম। ভেবেছিলাম যেদিকে আলোর রেখা দেখব সেদিকে এগোব। কিন্তু চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে আমি কোনও আলোর রেখা দেখতে পেলাম না। সোজা এগোতে শুরু করলাম। চারদিকে ঘন জঙ্গল। কিন্তু জঙ্গলটা ভয়ঙ্কর নীরব। কোনও পশুপাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি না। এমনকী ঝিঁঝিও ডাকছে না। কিছুক্ষণ একটানা হাঁটার পর আমি আবার একটা ফাঁকা জায়গা পেলাম। পা খালি হওয়াতে আমার হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। বিশ্রাম নেয়ার জন্য ফাঁকা জায়গাটায় বসলাম। হঠাৎ মনে হলো, একটু দূরে কেউ একজন বসে আছে। আমি এগিয়ে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’
‘আমি।’
‘আমি কে?’
‘আমার কোনও নাম নেই।’
‘কী করছেন এখানে?
‘বৃদ্ধ হয়েছি তো, পরিশ্রম সহ্য হয় না, তাই বিশ্রাম নিচ্ছি।’
‘এটা কোন্ জায়গা?’
‘এটা তোমার জন্য একটা নতুন জগৎ।’
‘আমি বুঝতে পারছি না।’
‘পৃথিবীর কোনও-কোনও মানুষকে এ জগতে আসতে হয়।’
‘কী বলছেন এসব!!’
হ্যাঁ। তবে সবাই এ জগৎ থেকে ফিরে যেতে পারে না। তাদের চিরদিনের জন্য এ জগতে থাকতে হয়!’
‘আপনিও কি আটকে পড়া একজন?’
‘না।’
‘তবে আপনি কে?’
‘আমি এ জগতের পাহারাদার!’
‘পাহারাদার?!!’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘তোমার বোঝার প্রয়োজন নেই।’
‘আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আপনি একটু কাছে এলে আমার ভয়টা একটু কমত।’
‘না, আমি কাছে আসব না।’
‘ঠিক আছে, আমিই কাছে আসছি।’
বড় আলখাল্লায় লোকটির পুরো শরীর ঢাকা। আমি তাঁর হাত-পা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু মুখ দেখতে পাচ্ছি না। আমাকে আসতে দেখে তিনি একটু দূরে সরে গেলেন। বললেন, ‘না, না, কাছে এসো না।’
আমি কথা না শুনে দৌড়ে এসে লোকটির হাত ধরলাম। হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন তিনি। তখন একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটল। লোকটির হাত খুলে গেল। হাতটা আমার হাতে ঝুলছে। আমি ঝটকা মেরে হাতটা ফেলে দেয়ার চেষ্টা করলাম।
পাহারাদার বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার হাতটা তোমাকে দিয়ে দিলাম।’ বৃদ্ধ হাসতে লাগলেন।
হাতটা আমার গলা চেপে ধরল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল আমার। কোনওমতে বললাম, ‘বাঁচাও…
একটু পর হাতটা আমার গলা ছেড়ে দিল। বৃদ্ধ বললেন, ‘বেশি কৌতূহল ভাল নয়। বুঝলে?’
আমার শরীর কাঁপুনি দিচ্ছে। দৌড় দিতে চাইলাম। কিন্তু হাত-পা কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে। চিৎকার করে বললাম, ‘ভূত-ভূত…আ-আপনি ভূত।’ বৃদ্ধ বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘না, আমি ভূত নই। আমি পাহারাদার।’
‘আ-আপনার হাত…হা-হাত…’
‘চুপ করো। শুধু হাত কেন, আমার শরীরের সব অংশই টান দিলে খুলে আসে।’
‘অ্যা!!!’
‘হুঁ। এই দেখো।’ বৃদ্ধ তাঁর অন্য হাত দিয়ে পা দুটি খুলে ফেললেন। আমার পেটের ভিতর কিছু যেন পাক দিয়ে উঠল। বৃদ্ধ আবার বললেন, ‘দাঁড়াও, এবার মাথাটা খুলি।’
‘না…না…না। থামুন, থামুন।’ আমি দৌড় দিলাম।
বৃদ্ধের হাত-পা আলাদা-আলাদাভাবে আমাকে ধরতে এগিয়ে আসতে লাগল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দৌড়াচ্ছি। কখনও পড়ে যাচ্ছি, ব্যথা পাচ্ছি। তবু থামছি না। একটা ভয়ঙ্কর হাসি শুনতে পেলাম। কেউ জোরে বলে উঠল, ‘বোকা, তুমি খুব বোকা।’
মনে হলো বৃদ্ধের গলা। কিন্তু আশপাশে কোথাও তাঁকে দেখতে পেলাম না। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। মনে হচ্ছে পানি খেতে না পারলে আর এক মুহূর্তও বাঁচব না। এমন সময় কেউ বলল, ‘অ্যাই।’
‘কে?’
‘আমি। এই তো এদিকে।’
আমি একটা ছোট বাচ্চা মেয়ের অবয়ব দেখতে পেলাম। তবে মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটি আস্তে-আস্তে বলল, ‘পানি খাবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই নাও।’ মেয়েটি আমার দিকে একটা পানির পাত্র এগিয়ে দিল।
আমি ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এখানে কী করছ?’
‘আমি আমার মাকে খুঁজছি।’
‘তোমার মা কোথায়?’
‘হারিয়ে গেছে।’
‘তুমি পানি পেলে কোথায়?’
‘সামনে অনেক পানি।’
‘সামনে কোথায়?’
‘ওই তো সামনে।’
‘তুমি এখানে এলে কীভাবে?’
‘আমি সবসময় এখানেই আছি।’
‘তুমি এখানকার সবকিছু চেনো?’
‘হ্যাঁ। চিনি।’
‘আমি এখান থেকে বেরোতে চাই। কোনদিকে যাব?’
‘নদীর দিকে যেতে হবে।’
‘নদীটা কোথায়?’
‘বলব না।’
‘তোমার মা-ও কি এখানে থাকতেন?’
‘হ্যাঁ। হঠাৎ করেই হারিয়ে গেছে।’
‘নদীটা কোথায় বললে, আমি তোমার মাকে খুঁজে দেব।’
‘মিথ্যা! তুমি মিথ্যা বলছ! তুমি জানো না আমার মা কোথায়।’
‘জানি। আমি জানি।’
‘জানো না। তুমি মিথ্যা বলছ,’ মেয়েটি চিৎকার করে উঠল। ‘তোমার শাস্তি পেতে হবে। মিথ্যাবাদীকে শাস্তি পেতে হয়।’