আম্মা চিৎকার করে বললেন, ‘রনি, তুই চলে যা। তোর আল্লাহর দোহাই লাগে তুই চলে যা।’
আম্মা আর ইব্রাহিম কাকা শক্ত করে ধরে রেখেছেন আব্দুর রশিদকে। তিনি ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছেন। রনি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। না, আব্বার ভয়ে নয়। এমন ক্রমাগত চিৎকার করলে আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়বেন, তখন নিজেকে বড্ড দায়ী মনে হবে।
রনিদের বাসায় প্রচুর মানুষ জড় হয়েছে। সবাই মজা দেখতে এসেছে। আব্দুর রশিদ চিৎকার করে বললেন, ‘আজ থেকে আমার কোনও ছেলে-মেয়ে নেই। আমি দুই কুত্তাকেই ত্যাজ্য করলাম।’
রনি মনে-মনে বলল, ‘আপনার এই দোজখে আর ফিরতে চাই না।’
পরিশিষ্ট
হীরা আর আনিসের বিয়ে পিছিয়ে দিয়েছে রনি। হীরা তার বাসায়ই আছে। ঢাকার একটা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। প্রস্তুতি ভাল না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়নি।
আনিস মাস্টার্স পাস করেছে। আগের মত মেসেই থাকছে। ঠিক করেছে একটা ভাল চাকরি পেয়েই হীরাকে বিয়ে করবে। আব্বা-আম্মা রনি এবং হীরার কোনও খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেননি। এমনকী একবার ফোনও করেননি। তবে গতকাল সেলিম রনিকে ফোন করেছিল। সে এমন একটা খবর দিল যে রনি হতবাক হয়ে পড়ল। তার ভাষাতেই বলা যাক:
‘তুই হীরাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছিস আগেই জেনেছিলাম। এসব ব্যাপার নিয়ে দুই গ্রামে নানা কথাবার্তা চলছিল। তবে বেশিরভাগ মানুষই বলেছে, ‘যাক, ভালই হলো। মেয়েটা সিদ্দিকুরের হাত থেকে বেঁচে গেল।’ কেউ-কেউ অবশ্য পুরো ঘটনায় মজাও লুটছে। সিদ্দিকুর আর তার বাবা তোদের বাসায় এসে অনেক চেঁচামেচি করেছিল। তারা এর শেষ দেখে নেবে এ-ও বলেছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। গভীর রাতে কেউ সিদ্দিকুর এবং তার মা-বাবার উপর অ্যাসিড ঢেলে দিয়ে গিয়েছিল। সিদ্দিকুরের মা-বাবাকে বাঁচানো যায়নি। সিদ্দিকুর কোনওমতে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার চোখ, কান, শ্বাসনালীসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিদ্দিকুর আর কোনওদিন চোখে দেখবে না, কানেও শুনবে না। এমনকী এখনও সে ঠিকমত কথাও বলতে পারে না। হাসপাতালেই আছে এই সাত দিন। বারবার কী যেন বলার চেষ্টা করে। তার ভাঙা-ভাঙা কথা শুনে মনে হয় লাল শাড়ি পরা দুটো মেয়ে তাদের উপর অ্যাসিড ঢেলেছে। সেই মেয়েদের শরীরে নাকি অসুরের মত শক্তি। অনেক সময় নিয়ে তারা অ্যাসিড ঢেলেছে। গ্রামের মানুষ এ ঘটনায় খুবই খুশি। সবাই মেয়ে দুটোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।’
রনি বিড়বিড় করে বলল, ‘ধন্যবাদ, আমেনা এবং জমিলা।’
আঁধারে বসতি
আমি একটা অন্ধকার জায়গায় শুয়ে আছি। যতবার চোখ মেলে তাকাই, কিছু দেখতে পাই না। প্রচণ্ড একটা ভয়ের অনুভূতি আমায় জাপটে ধরে। জায়গাটা আশ্চর্যরকম নীরব। আমি খুকখুক করে কেশে উঠলাম। মনে হলো কাশির শব্দ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। আমি কি মারা গেছি? নাকি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি? আমি সম্ভবত কোনও মাঠে শুয়ে আছি। আস্তে-আস্তে উঠে বসলাম। আমাকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। আমি কীভাবে এখানে এলাম? আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে, বন্ধু মাহমুদ আমাকে খারাপ কিছু খাইয়ে দিয়েছে? হয়তো আমি নেশার ঘোরে আছি। মাহমুদের আবার উল্টাপাল্টা জিনিস খাওয়ার অভ্যাস আছে।
আমি মারা যাইনি, এটা বেশ বুঝতে পারছি। হাত-পা ইচ্ছামত নাড়াতে পারছি। একটা মশা ভয়াবহ কামড় দিল। ব্যথা পেলাম। চারপাশে কেমন একটা কটু গন্ধ পাচ্ছি। মারা গেলে বা স্বপ্ন দেখলে এসব অনুভূতি কাজ করার কথা না। কিন্তু জায়গাটা এত অন্ধকার কেন? আমি চিৎকার করে বললাম, ‘কেউ আছেন?’
কেউ জবাব দিল না। মনের ভিতর ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাচ্ছে। এত ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ একটা আশঙ্কা আমায় পেয়ে বসল। আমি হয়তো অন্ধ হয়ে গেছি। তাই কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু হুট করে অন্ধ হলাম কী করে? না, হিসাব মিলছে না। খিদেও পেয়েছে বেশ। চোখের সামনে নান আর মুরগির গ্রিলের ছবি ভাসছে। প্রায় প্রতি রাতেই আমি নান আর মুরগির গ্রিল খেয়ে থাকি। সঙ্গে কড়া লিকারের এক কাপ চা।
না, এভাবে বসে থাকা সম্ভব না। আমি আবার বললাম, ‘কেউ আছেন?’
গম্ভীর গলায় কেউ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আছি।’
‘কে আপনি?’
‘আমি কেউ না।’
‘আমি কোথায় আছি?’
‘নিজেই বুঝতে পারবে।’
‘আমি কি বেঁচে আছি?’
‘না।’
‘তবে মারা গেছি?!!’
‘না। মারা যাওনি।’
‘মানে?!!’
‘শান্ত হও। সব বুঝতে পারবে।’
‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’
‘হতে পারে এটা এক ধরনের স্বপ্ন। আবার না-ও হতে পারে।’
‘আমার ভয় করছে। প্রচণ্ড ভয়।’
‘ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আরও অনেক কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
‘আপনি কি আমার হাতটা একটু ধরবেন?’
‘না।’
‘এত অন্ধকার কেন?’
‘একটু পরে অন্ধকার কমে যাবে।’
‘তাই?!’
‘হ্যাঁ। তুমি সবকিছু আবছা দেখতে পাবে।’
‘এই অন্ধকার পুরোপুরি দূর হবে কখন?’
‘এই অন্ধকার পুরোপুরি দূর হবে না।’
‘আমাকে বাঁচান।’
‘হা-হা-হা।’
‘ভয় লাগছে…আমার ভয় লাগছে।’
‘মাটিতে শুয়ে পড়ো।’
‘কেন?’
‘যা বলছি করো।’
আমি শুয়ে পড়লাম।
লোকটা আবার বলল, ‘একটু পরে অন্ধকার কমে যাবে। তুমি সবকিছু আবছা দেখতে পাবে। তখন মাটি থেকে উঠে পড়বে। এরপর হাঁটতে শুরু করবে।’