‘ভাইয়া, আমাকে কী করতে বলছেন?’
‘আগে নিজের মনকে প্রশ্ন করো, হীরাকে তুমি বিয়ে করতে চাও কি না?’
‘ভাইয়া, অবশ্যই চাই। হীরা আমার জীবনে না এলে হয়তো সবই হারিয়ে ফেলব।’
‘তা হলে নিজেই ভেবে বলো, তোমার কী করা উচিত।’
‘আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। কিন্তু হীরা কি চাচার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে?’
‘হীরা আর তুমি ঢাকায় চলে যাও। এরপর সেখানে বিয়ে সেরে নাও। যদিও আমি চেয়েছিলাম হীরার বিয়েটা আরও কয়েক বছর পর হোক। কিন্তু পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে তোমাদের বিয়ে করে নেয়াই ভাল। বিয়ের পর আমার বাসাতেই তোমরা থাকবে। তুমি চাকরির চেষ্টা করবে আর হীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে।’
আনিস আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ল। ‘ভাইয়া, আপনি…’ আনিসের চোখে পানি দেখতে পেল রনি। পুরুষমানুষের চোখে পানি অনেক বড় ব্যাপার। রনির মনে হচ্ছে, এই ছেলেটার কাছে তার বোন সুখেই থাকবে।
রনি বলল, ‘আনিস, মন নরম করলে চলবে না। অনেক বড় মানসিক শক্তি দরকার তোমাদের।’
‘ভাইয়া, আমি শক্তই আছি। আমার অনেক স্বপ্ন। সংসারের কথা চিন্তা করে আমি ছোটখাট সঞ্চয় করেছি। সে সঞ্চয় এখন তিন লাখ টাকা হয়েছে।’
‘খুবই ভাল। এত টাকা কীভাবে জমালে?’
‘আমি প্রচুর টিউশনি করি। টিউশনির টাকাই একটু-একটু করে জমিয়েছি।’
‘খুব ভাল। ওই টাকাটা এখন খরচ কোরো না। চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই টাকায় হাত দেবে না।’
‘জি, ভাইয়া।’
‘দু’দিনের মধ্যে তোমরা ঢাকা যাবে। আমার বাসার ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। বাসার চাবিটাও মনে করে নিয়ে নিয়ো।’
‘আপনি আমাদের সাথে যাবেন না?’
‘নাহ, এখনই যাব না। আমি এদিকটা সামলাব। দেখব আব্বা কী করেন। ওনাকেও তো সামলাতে হবে।’
‘আচ্ছা, ভাইয়া।’
‘আমি হীরাকে সব বলব আজকে। তুমি তৈরি থেকো।’
.
পরিস্থিতি মানুষকে সাহসী করে দেয়। রনি ভেবেছিল হীরা আব্বার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে ভয় পাবে, কিন্তু তাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে সহজেই রাজি হয়ে গেল। আব্বার প্রতি তার ক্ষোভও দীর্ঘদিনের।
রনি বলল, ‘কিছু জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখিস। আর এই চার হাজার টাকা রাখ। সোজা আমার বাসায় যাবি। একটা বেডরুম খালি পড়ে আছে, তোদের থাকতে কোনও সমস্যা হবে না।’
হীরার মুখটা শুকনো। মুখের সেই চিরাচরিত হাসিটা যেন নিভে গেছে।
রনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় লাগছে?’
‘হ্যাঁ, ভাইয়া, লাগছে। যদি আব্বা জানতে পারেন, তা হলে…’
‘আমি নিজে তোদের ঢাকার বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসব। রাত এগারোটার বাসে যাবি। এই সময় কেউ জেগে থাকবে না।’
.
সহজে হয়ে গেল সবকিছু। রাত এগারোটার বাসে হীরা আর আনিসকে উঠিয়ে দিয়েছে রনি। হীরা খুব কাঁদছিল। বেচারী খুব ভয় পাচ্ছিল। যদিও বড় ভাই ওর পাশে আছে, তবু এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ নয়। যতই আশ্বস্ত করা হোক না কেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া একটা মেয়ের জন্য অনিশ্চিত যাত্রার মত। রনি আনিসকে অনেকবার বলেছে যেন হীরাকে দেখেশুনে রাখে। এই মেয়েটা শহরের পরিবেশ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না।
ছয়
রাতে বাসায় ফিরতে-ফিরতে প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল রনির। সারারাত ঘুমাতে পারেনি। শুধু এপাশ-ওপাশ করেছে। শেষ রাতের দিকে নিজের অজান্তেই চোখটা একটু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার।
রনির ঘুম ভাঙল আব্বার চেঁচামেচি শুনে। আব্দুর রশিদ রনির ঘরের দরজায় সজোরে লাথি দিচ্ছিলেন। রনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। আব্বা কি তবে সব জেনে গেছেন?
আব্দুর রশিদ চিৎকার করছেন, ‘দরজা খোল, হারামজাদা।’
রনি শান্তমুখে দরজা খুলে দিল।
আব্দুর রশিদের মুখ ক্রোধে লাল হয়ে আছে। তাঁর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। হাতে একটা ধারাল দা চকচক করছে। রনির ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু ও অবাক হয়ে লক্ষ করল তার ভয় করছে না। আব্দুর রশিদ দা উঁচু করে বললেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, বল, হীরা কোথায়?’
‘ঢাকায় গেছে, আব্বা।’
‘ওর নাগরের সাথে গেছে? তুই ওদের পাঠিয়েছিস, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওই হারামজাদী চিঠি লিখে গেছে। কী সুন্দর সেই চিঠির ভাষা।’ দাঁতে-দাঁত চেপে আব্দুর রশিদ বললেন, ‘আজ তোকে টুকরো-টুকরো করে কুকুরকে খাওয়াব।’
‘আপনার সাহস থাকলে আমাকে কোপ দেন।
‘কী বললি?’
‘বলেছি আপনার সাহস নেই আমাকে কোপ দেয়ার। আছে শুধু হম্বিতম্বি।’ আব্দুর রশিদ অবাক দৃষ্টিতে রনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে তিনি নিজের ছেলেকে চিনতে পারছেন না।
রনি সোজাসুজি আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সিদ্দিকুর একটা খুনি। সে তার আগের দুই বউকে খুন করেছে। গ্রামের মানুষকে বহু বছর ধরে তারা নির্যাতন করে আসছে। এমন একটা পরিবারে আমি আমার বোনকে বিয়ে দিতে পারব না। আপনি বাবা হিসাবে ব্যর্থ হতে পারেন, আমি ভাই হিসাবে ব্যর্থ হতে পারব না।’
আব্দুর রশিদ যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন। রনি তাঁর চোখে অন্য দৃষ্টি দেখতে পেল। তিনি হারতে চান না। এবার বোঝা যাচ্ছে তিনি সত্যিই রনিকে কোপ দেবেন। আব্দুর রশিদ চিৎকার করতে-করতে রনির দিকে এগিয়ে আসছেন। ও অপেক্ষা করছে। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাওয়ার অপেক্ষা। ঠিক সেই মুহূর্তে রনির আম্মা এবং পাশের বাড়ির ইব্রাহিম কাকা ঘরে ঢুকলেন। আব্দুর রশিদকে চেপে ধরলেন তাঁরা। তিনি তখন পশুর মত শব্দ করছেন, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। বলছেন, ‘ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও। এই শুয়োরকে মেরে আমি একটা পুণ্য করতে চাই।’