সেলিমের ভয়টা দেখে রনি বুঝতে পারল সিদ্দিকুর রহমান কতটা নিষ্ঠুর চরিত্রের।
চার
জীবনে প্রথমবারের মত আব্বার সঙ্গে কথা বলতে রনি কোনও ভয় পাচ্ছে না। বেশ স্পষ্ট স্বরেই বলল, ‘আব্বা, সিদ্দিকুর লোকটা ভাল না।’
২৩৮
আব্দুর রশিদ কঠিন চোখে রনির দিকে তাকালেন। ‘কী বললে?’
‘আপনি জানেন, সিদ্দিকুরের আগে বিয়ে আছে?’
‘হ্যাঁ, জানি।’
রনির মাথায় যেন বাজ পড়ল। ‘আপনি জানেন?!!’ উত্তেজনায় চেয়ার থেকে
দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘এত লাফাচ্ছ কেন? জানি তো আগে একবার বিয়ে করেছিল। বউটা আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল।’
‘আব্বা, সিদ্দিকুর আর তার বাবা-মা মিলে ওই বউটাকে মেরেছিল।’
‘একদম চুপ। বাজে কথা বলবে না।’
‘শুধু তাই নয়। আরও একটা মেয়েকে বিয়ে করে সিদ্দিকুর মেরে ফেলেছিল। গ্রামের অনেক মানুষের উপরে নির্যাতনের ইতিহাসও আছে ওদের। সিদ্দিকুরের চরিত্রও তেমন সুবিধার না।’
‘বাহ! এতদিন গ্রামে থেকে আমি কিছু জানতে পারিনি, আর তুমি দেখি এক রাতের মধ্যে সব কিছু জেনে গেছ!’
রনি আব্বার বিদ্রূপটা গায়ে না মেখে বলল, ‘কোনওভাবেই সিদ্দিকুরের সাথে হীরার বিয়ে দেবেন না, আব্বা।’
‘তুমি যা-যা বললে সব গ্রামের মানুষের রটনা। মানী লোক সম্পর্কে গ্রামের মানুষ খারাপ কথা ছড়াতে পছন্দ করে।’
‘আমি কোনওভাবেই এই বিয়ে হতে দেব না।’
আব্দুর রশিদ শক্ত করে চেয়ারের হাতল ধরলেন। তিনি রাগে অস্থির হয়ে আছেন বোঝা যাচ্ছে। বললেন, ‘সিদ্দিকুর একটা বিয়ে করেছিল। তার বউটা রান্নাঘরের আগুনে মারা গিয়েছিল। এটুকুই সত্যি। আর কিছুই সত্যি নয়। আর তুমি বিয়ে বন্ধ করার কে? এখনও আমার হাতে জোর আছে, মনে রাখবে। বেয়াদবকে সোজা করার উপায় আমার জানা আছে। আমার সামনে থেকে যাও।’
রনি উঠে দাঁড়াল।
‘তোমার শাস্তির ব্যবস্থা আমি অবশ্যই করব। আমি দুষ্ট গরু পুষতে চাই না।’
রনি মনে-মনে বলল, ‘আপনার গোয়ালে আমি আগুন দেব, আব্বা। আপনার গোয়াল শুধু শূন্যই থাকবে না, ধ্বংসও হয়ে যাবে। আপনার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি, আর না।’
পুরানো একটা দুঃখের স্মৃতি মনে পড়ে গেল রনির। রনির বয়স যখন আঠারো, তখন আব্বা তার বিয়ে দিয়েছিলেন। একরকম বাধ্যই করেছিলেন বিয়ে করতে। আব্দুর রশিদের যুক্তি ছিল অল্প বয়সে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিলে তাদের জীবন সুখের হবে। কিন্তু রনির জীবন সুখের হয়নি। রনির বারো বছর বয়সী বউ শাহানা আব্দুর রশিদের পরিবারের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। তবে রনির কেন যেন মনে হয়, শাহানা তাকে একটু-একটু পছন্দ করত। বাসর রাতে সে অনেক গল্প করেছিল। তার জীবনের গল্প। তাদের বাসার গাভীটার একটা নতুন বাছুর হয়েছিল, বাছুরটা তার গলা শুনলেই দৌড়ে আসত। তার বান্ধবী সীমা নাকি মাছের মত সাঁতার কাটে, কোনও ছেলেও তাকে হারাতে পারবে না। রিয়াজ- শাবনূরের নতুন সিনেমাটা দেখে নাকি চোখে পানি এসে যায়। রনির সে-রাতে মনে হয়েছিল, আল্লাহ শুধু তার জন্য এই বিশেষ মেয়েটিকে তৈরি করেছেন। শাহানার মধ্যে রনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল।
কিন্তু সুখ রনির ভাগ্যে ছিল না। বিয়ের পরদিন থেকে আব্দুর রশিদের কড়া শাসনের মধ্যে পড়ে গেল শাহানা। রনির আম্মা এমনিতে আব্দুর রশিদের কাছে কোনও কাজে পাত্তা পান না। তবে আব্দুর রশিদ যখন কারও প্রতি অন্যায় করেন, তখন রনির আম্মা তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যান। সে অর্থে তিনিও একজন নিষ্ঠুর মানুষ।
রনির আব্বা, আম্মা দু’জনে মিলে শাহানার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছিলেন কিশোরী মেয়েটা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করত। কাজের পুরস্কার হিসাবে ছিল শ্বশুরের ধমক আর শাশুড়ির টিপ্পনী। তার খাওয়া-দাওয়ার দিকেও কারও নজর ছিল না। তার পোশাক-আশাক ছিল চাকরানির মত। অবাক ব্যাপার হচ্ছে শাহানা কখনও রনির কাছে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করলেও অবশ্য রনির কিছু করার ছিল না।
শাহানার পরিবারের সদস্যরা এই নির্যাতনের বিষয়ে সবই জেনেছিল। তারা ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। ফলে, দুই মাসের মধ্যেই তালাক সম্পন্ন হয়েছিল। রনি শুনেছে শাহানার আবার বিয়ে হয়েছে। একটা বাচ্চাও নাকি আছে। লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে, এখনও রনি আনমনে সেই কিশোরী মেয়েটার কথা ভাবে। গোলগাল মুখ, মিষ্টি চেহারা, চোখে-মুখে কৌতূহল ভরা যে মেয়েটাকে দেখে রনি মুগ্ধ হয়েছিল।
তালাক হয়ে যাওয়ার কয়েক বছর পর, আব্দুর রশিদ আবার রনির বিয়ের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু রনি কোনওক্রমেই রাজি হয়নি। রনির নিজের জীবনে যে খারাপ বিষয়টা ঘটে গেছে, তা সে কোনওক্রমেই হীরার জীবনে ঘটতে দেবে না, কিছুতেই না।
পাঁচ
আনিস ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছে। হীরাই সংবাদটা রনিকে দিয়েছে। রনি দেরি না করে আনিসদের বাসায় গেল। আনিসদের বাসা কাছাকাছি। রনিকে দেখে আনিস কিছুটা ভড়কে গেল। কোনওকিছু নিয়ে শঙ্কায় ভুগছিল হয়তো। রনি তার সব শঙ্কা, দূর করে বলল, ‘তোমার আর হীরার বিষয়টি আমি জানি।’
আনিসের মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল।
রনি বলল, ‘এখন কী করবে ভাবছ?’
‘ভাইয়া, আমার তো তেমন কিছু করার নেই। চাচা না চাইলে তো কেউই কিছু করতে পারবে না।’
‘কোনওকিছুতে জয়ী হতে চাইলে জেদ থাকা প্রয়োজন। আব্বা যতটা না রাগী, তার চেয়ে বেশি জেদি। তাঁর এই জেদের জন্যই জীবনে সব বিষয়ে তিনি সফল। আমার মনে হয় তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মাথা তুলে দাঁড়ালে তিনি হতভম্ব হয়ে যাবেন।’