রনি রাজি হলো, মানে হতেই হলো। এরকম অকৃত্রিম ভালবাসাকে অগ্রাহ্য করা খুব কঠিন।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন দেখে রনি হতবাক হয়ে গেল। বড় রুই মাছ, দেশি কই, চিংড়ি, মোরগের মাংস, শিম ভর্তা, মসুরের ডাল, আচার এবং দই। এত অল্প সময়ে এত আয়োজন! শহরে কোনও আত্মীয়ের বাসায় এই ভালবাসার এক ভাগও কল্পনা করা যায় না। ‘আহা! গ্রামে যদি ফিরে আসতে পারতাম। পুরনো কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।’ রনির মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল কথাগুলো।
প্রিয় পুকুর ঘাটে অনেকদিন পরে বসেছে রনি আর সেলিম। হাতে পাতার বিড়ি। পাতার বিড়ি খাওয়ার মাধ্যমে তাদের পুরানো আনন্দ যেন আবার ফিরে এসেছে। সুন্দর বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। আর আকাশে চাঁদও রয়েছে। এত সুন্দর পরিবেশ যে তাদের মনে হচ্ছে অনন্তকাল এখানে বসে থাকে। নতুন- পুরানো নানা গল্প চলল দুই বন্ধুর। রনির কথা কতটা মনে পড়ে সেটাও জানিয়ে দিল সেলিম। কথায়-কথায় হীরার বিয়ের প্রসঙ্গটা তুলল রনি। প্রথমে বেশ আগ্রহ দেখালেও সিদ্দিকুর রহমানের কথা শুনে সেলিমের উৎসাহটা মিইয়ে গেল।
রনির দিকে না তাকিয়ে শুধু বলল, ‘তা হলে তোর বোনের সাথেই সিদ্দিক ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে?’
‘তুই বিয়ের বিষয়ে আগেই জেনেছিলি?’
‘হ্যাঁ, শুনেছিলাম সিদ্দিক ভাই বিয়ে করতে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা যে আমাদের হীরা তা জানতাম না।’
‘হুম।’ আড়চোখে সেলিমের দিকে তাকিয়ে রনি বলল, ‘সিদ্দিকুর রহমান লোক কেমন?’
সেলিম রনির দিকে একনজর তাকাল। তারপরেই চোখ নামিয়ে নিল। মিনমিন করে বলল, ‘হ্যাঁ, ভালই তো।’
রনি সেলিমের কাঁধ ধরে বলল, ‘দেখ, সেলিম, এটা আমার বোনের জীবনের প্রশ্ন। তুই সিদ্দিকুর সম্পর্কে খারাপ, ভাল যা-ই জানিস, আমাকে বল। কিছু লুকাবি না।’
‘মানুষটা ভাল না রে,’ সরাসরি বলে বসল সেলিম। ‘যেহেতু বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তাই কিছু বলতে চাইছিলাম না।’
সেলিমের কথায় মনের মধ্যে ধাক্কা লাগলেও স্বাভাবিক গলায় রনি বলল, ‘বিয়ে শুধু ঠিক হয়েছে, হয়ে তো যায়নি। আমাকে সব খুলে বল।’
‘খুলে বলার খুব বেশি কিছু নেই। সিদ্দিকুর রহমানের বাবা খিজির রহমান গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ। বহু মানুষের জমা-জমি দখল করে অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছে। সিদ্দিকুর রহমানও বাবার ধারা অব্যাহত রেখেছে। গ্রামের মানুষ এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ।’
‘হুম।’
‘আর একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে সিদ্দিকুরের চরিত্রও তেমন ভাল না। গ্রামের বহু মেয়ের দিকে সে নজর দিয়েছে। তার জন্য অনেক মেয়েকে গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। তুই কি জানিস সিদ্দিকুরের আগের একটা বিয়ে আছে?’
‘বলিস কী!’
‘হ্যাঁ, আমেনা নামে এই গ্রামের একটা অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছিল। একদিন জানতে পারলাম রান্নাঘরে আগুন লেগে আমেনা মারা গেছে। গ্রামের সবাই ছুটে গেলাম সিদ্দিকুরদের বাড়িতে। দেখলাম গোলপাতার রান্নাঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাউকে লাশও দেখতে দেয়া হয়নি। তড়িঘড়ি করে বাড়ির পিছনের কবরস্থানে আমেনাকে কবর দেয়া হয়। আমেনার মৃত্যু নিয়ে লোকজনের মধ্যে নানান কানাঘুষা আছে।’
‘কী কানাঘুষা?’
এটা বলা ঠিক হবে না রে। মানুষ তো আজগুবি কথা বলতে পছন্দ করে। এগুলো বিশ্বাস না করাই ভাল।’
‘আমাকে বল, সেলিম। আমি অবুঝ মানুষ নই, কিছু শুনেই আমি হুট করে বিশ্বাস করে ফেলি না।’
নিচু গলায় সেলিম বলল, ‘অনেকে বলে সিদ্দিক এবং তার বাবা-মা মিলে আমেনাকে মেরে ফেলেছে।
‘ওহ, আল্লাহ!’
‘হ্যাঁ, তাদের ভাষ্য মতে আমেনাকে অ্যাসিডে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এরপর রান্নাঘরে আগুন লাগার নাটক সাজানো হয়েছে।’
রনি কী বলবে বুঝতে না পেরে সেলিমের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
সেলিম আবার বলল, ‘সিদ্দিক এবং তার বাবা শত্রুদের অ্যাসিডে ঝলসে দেয়। অতীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে তারা এত ক্ষমতাশালী যে কেউ পুলিশের কাছে যেতে সাহস পায়নি। অনেক গুণ্ডা পোষে সিদ্দিকুর রহমান, পুলিশের সাথেও বেশ দহরম মহরম। বুঝতেই পারছিস।’
‘আচ্ছা, সিদ্দিকুর কি জমিলা নামে কোনও মেয়েকে বিয়ে করেছিল?’
সেলিম শক খাওয়ার মত চমকে উঠল। তার কথায় জড়তা চলে এল। ‘তু- তুই তু-তুই জ-জমিলার কথা কীভাবে জানলি?’
‘সত্যি কি না বল?’
‘জমিলাকে আমি কোনওদিন দেখিনি। গ্রামের কিছু মানুষ জমিলার কথাও বলত একসময়। সিদ্দিকুর নাকি দূরের এক গ্রাম থেকে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে এনেছিল। বিয়ের তিন দিনের মাথায় সে নিখোঁজ হয়েছিল। তবে জমিলাকে গ্রামের কোনও মানুষ চোখে দেখেনি। হতে পারে এটা একটা গুজব।’
‘আমি এখন কী করব, রে?’
‘আমিও তাই ভাবছি। হীরাকে সিদ্দিকুরের বউ হিসাবে দেখব ভাবতেই পারছি না।’
‘আব্বা এই পরিবার সম্পর্কে ঠিকমত খোঁজখবর না নিয়ে কীভাবে বিয়ে ঠিক করলেন?’
‘চাচাজান হয়তো খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে সিদ্দিকুরদের বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলার সাহস কারও নেই।’
‘চল, শুয়ে পড়ি। ভাল লাগছে না।’
‘তোর মনটা খারাপ করে দিলাম!’
‘মনটা এমনিতেই খারাপ। তোর কথায় বরং আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। তুই যে আমাদের কত বড় উপকার করলি…’ সেলিমের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল রনি।
সেলিম এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘একটা অনুরোধ, আমি যে তোকে এসব বলেছি, কাউকে বলবি না।’