‘কী বলছেন এসব? কেন?’
‘সিদ্দিকের সাথে বিয়ে না দিয়ে বোনকে পুড়িয়ে মেরে ফেলুন।’
মেয়েটা আসলেই পাগল, বোঝা যাচ্ছে। তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
‘আপনি কে?’ পুরানো প্রশ্নটা আবার করল রনি।
‘আমি আমেনা।’
‘ওহ।’
‘আমি সিদ্দিকের প্রথম বউ।’ আমেনার গলায় নিস্পৃহ ভাব।
‘অ্যা! সিদ্দিকুরের আগের বউ আছে? এটা তো জানতাম না। আপনি কি সত্যি বলছেন?’ নিজের বিস্ময়টা লুকাতে পারল না রনি।
‘হা-হা। আরও অনেক কিছুই আপনারা জানেন না।’
ঠিক সেই মুহূর্তে আরও একটা মেয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল। এর পরনেও লাল রঙের শাড়ি। আগের মেয়েটার মত সে-ও আঁচল সামনের দিকে টেনে রেখেছে।
এই মেয়েটা নিজ থেকেই বলল, ‘আমি জমিলা। সিদ্দিকের দ্বিতীয় বউ।’
রনির মাথা ঘুরে উঠল। কী দেখছে এসব। সিদ্দিকের আগের বউ আছে। দু’জনেই পাগল? এটা কীভাবে হয়? নাকি এই মেয়ে দুটো মিথ্যা বলছে?
কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বরের মধ্যে এক ধরনের বেদনার ছাপ রয়েছে, গভীর বেদনা নিয়ে মিথ্যা বলাটা কঠিন।
আমেনা বলল, ‘আমি সিদ্দিকের সাথে দুই বছর সংসার করেছিলাম। সিদ্দিকের মা-বাবা আর সিদ্দিক দিনরাত আমার উপর নির্যাতন করত। এরপর একদিন…’
‘একদিন কী?’
‘সিদ্দিক আর তার বাবা আমার সারা শরীরে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। তারপর আমাকে এই রুমে ফেলে রাখে।’
রনি আঁতকে উঠল। ‘অ্যাসিড!!!’
‘হ্যাঁ। এদের গোপন কয়েকটা কারখানা আছে। সেখানে অ্যাসিড মজুত করে রাখা আছে। কাউকে শায়েস্তা করার দরকার হলেই এরা অ্যাসিডকে কাজে লাগায়।’
আমেনাকে থামিয়ে দিয়ে জমিলা বলল, ‘আমার দুই বছর সংসার করার সৌভাগ্য হয়নি। আমাকে গোপনে বিয়ে করে এনেছিল সিদ্দিক। বিয়ের তিন দিনের মাথায় বদমাশটা আমার শরীরে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। আমাকেও এই রুমে ফেলে রেখেছিল। এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছিল যে, গ্রামের লোকজনও সিদ্দিকের দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানে না।’
‘আপনারা কী পাগলের মত কথা বলছেন? আপনারা বলছেন সারা শরীরে অ্যাসিড মেরে এখানে ফেলে রেখেছিল। তা হলে চিকিৎসা ছাড়া আপনারা বেঁচে আছেন কীভাবে?’
দু’জনেই ভয়ঙ্করভাবে হেসে উঠল। রনির হাতে-পায়ে শীতল ভাব ছড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। জানালার সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে রনি। তবে অদ্ভুত কোনও আকর্ষণ তাকে সেখানে আটকে রেখেছে। কিছু একটা রনি দেখতে চায় না, কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে দেখতেই হবে।
ঘটনাটা ঘটল খুব দ্রুত। আমেনা এবং জমিলা এক ঝটকায় মুখের উপর থেকে আঁচল সরিয়ে নিল। রনির মুখ দিয়ে মৃদু আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল। রনি পিছনের দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়াল। বুঝতে পারছে তার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে, ঘামে ভিজে গেছে শরীরের অনেকটা অংশ। এ ভয়ঙ্কর দৃশ্য রনি দেখতে চায় না। সে চোখ বন্ধ করল। মনে হলো, চোখ খুললেই দেখবে সামনের সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু তা হলো না। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা রনিকে বারবার দেখতে হলো।
রনি দেখল আমেনা এবং জমিলার মুখ, গলা, হাত ঝলসে গেছে। মুখমণ্ডলে চোখের কোনও অস্তিত্ব নেই, নাক এবং ঠোঁট যেন একসঙ্গে মিশে গেছে, কোথাও- কোথাও মাংস খসে পড়েছে, মাথায় চুল নেই একটাও।
জমিলা হেসে বলল, ‘বিশ্বাস হয়েছে আমাদের কথা? শরীরের সব জায়গায়ই এই অবস্থা। সব আপনাকে দেখাতে পারব না।’
রনি শক্ত করে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে যে কোনও সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
জমিলা বলল, ‘নিজের বোনের যদি এমন অবস্থা দেখতে চান, তবে অবশ্যই সিদ্দিকের সাথে বিয়ে দেবেন। তখন এই ঘরে আমরা তিনজন থাকব। মাঝে- মাঝে আমাদের তিনজনকে দেখে যাবেন।’
আমেনা গলা নামিয়ে বলল, ‘আমাদের কাছেও অ্যাসিড আছে। একদিন আমরাও সিদ্দিক আর ওর মা-বাবার উপর অ্যাসিড ঢেলে দেব।’
রনি আর দাঁড়াতে পারল না। বাথরুম সেরে দৌড়ে বসার রুমে ফিরে গেল। আব্দুর রশিদ রনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে? এভাবে ঘেমেছ কেন?’
রনি ঠিকভাবে বসতে পারছে না। তার মুখের মধ্যে শুকনো খটখটে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কথা বলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে।
‘চলো, আজ তা হলে উঠি,’ আব্দুর রশিদ রনির দিকে তাকিয়ে বললেন। রনি নিশ্চুপ। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে।
সিদ্দিকুর রহমান আব্দুর রশিদের পা ছুঁয়ে সালাম করল। আব্দুর রশিদ চাপা গলায় বললেন, ‘দেখেছ কেমন ভদ্র ছেলে! মাশা’আল্লাহ।’
রনি দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।
ফুলমণি গ্রাম থেকে রনিদের গ্রাম আশামণির দূরত্ব খুব বেশি নয়। ভ্যানে বা রিকশায় করে সবাই যাতায়াত করে। রনি আব্বাকে ভ্যানে তুলে দিয়ে বলল, ‘আব্বা, আপনি বাড়ি চলে যান। আমি একটু পর আসছি।’
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘এই গ্রামে আমার একটা বন্ধু আছে। তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা, যা। রাতে তুই বাসায় ফিরলে বিস্তারিত কথা বলব।’
তিন
অনেকদিন সেলিমদের বাসায় যায়নি রনি। পুরানো বন্ধুর সঙ্গে বহু বছর পর দেখা হলেও কোনও সমস্যা হয় না, আন্তরিকতায় এতটুকু খাদ থাকে না। সেলিম রনিকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরল। ওর মা-বাবার মুখেও হাসি ফুটল। রনি অনেকবার বলার চেষ্টা করল, ‘একটু পরেই চলে যাব।’ সেলিম কঠিন গলায় উত্তর দিল, ‘আজ যেতে পারবি না। পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে। আর আব্বা মোরগ জবাই করবে। আজ রাতে তোকে ছাড়ছি না, আজ একসাথে খাওয়া-দাওয়া করব আর সারারাত পুকুর পাড়ে বসে গল্প করব।’