‘বয়সে বড় ছেলেই সংসার করার জন্য ভাল। এরা আবেগে চলে না। বুঝে- শুনে সিদ্ধান্ত নেয়।
‘কিন্তু হীরার তো এই বিয়েতে মত নেই।
‘হীরার যদি মত না থাকে সেটা আমার সামনে এসে বলতে বলো। দেখি কত সাহস!’ আব্দুর রশিদের হাত মুষ্টিবদ্ধ। তিনি যখন খুব বেশি রেগে যান, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখেন। রনির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার সাথে এই বিষয়ে আমি আর কোনও কথা বলতে চাই না। কাল তুমি আমার সাথে সিদ্দিকদের বাসায় যাবে, এটাই শেষ কথা। আর আমার সাথে কখনওই এমন উঁচু স্বরে কথা বলবে না।’
রনির ভিতরটা কেঁপে উঠল। আব্বার কথার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস তার কখনওই ছিল না। কিন্তু আদরের বোনটার এই সমস্যা রনিকে কেমন যেন বদলে দিয়েছে। আব্বা যখন বলছেন তখন কাল সিদ্দিকুরদের বাসায় যাবে রনি। ছেলে কেমন এটাও তার জানা দরকার, আব্বার কথার উপর কোনও ভরসা নেই।
.
হীরার হবু বরের পুরো নাম সিদ্দিকুর রহমান। তার বাবার ভালই টাকা-পয়সা আছে বোঝা যাচ্ছে। পাশাপাশি বিশাল দুটো দোতলা বাড়ি। এই গ্রামে এমন আর একটাও বাড়ি আছে কি না সন্দেহ। রনিদের যে ঘরটাতে বসতে দেয়া হয়েছে তার সাজসজ্জা চোখে পড়ার মত। ঘরের মেঝেতে কার্পেট, দেয়ালে কিছু মহামানবের ছবি, শৌখিন সোফা আর ৩১ ইঞ্চি বিশাল এলইডি টিভি। দেখে কেউ বুঝতে পারবে না এটা গ্রামের কোনও বাড়ি। আব্দুর রশিদের মুখে বিজয়ীর হাসি। সম্ভবত তিনি ছেলেকে বোঝাতে চাইছেন, দেখো, কত বড় ঘরে হীরার বিয়ে ঠিক করেছি।
পাত্রপক্ষ যত্নের চূড়ান্ত করলেন। সিদ্দিকুর রহমান রনির চেয়ে বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভাইয়া ডাকছে। রনি এতে কিছুটা বিব্রত বোধ করছে। সিদ্দিকুর রহমান মাথা নিচু করে বললেন, ‘আমার বউয়ের বড় ভাই মানে আমার বড় ভাই। এখানে বয়স কোনও বিষয় না। আমি বড় ভাইকে অবশ্যই সম্মান করব।’
সিদ্দিকুরের বাবাও বেশ কিছু কথা বললেন। বেশ অপরাধী মুখ করে বললেন, ‘এর আগের দিন আপনাদের একটা অন্যায় কথা বলেছিলাম।’
আব্দুর রশিদ বললেন, ‘কী কথা?’
‘বলেছিলাম, আমাদের একটা কাজের লোকের মত বউ দরকার। আমি অশোভন কথা বলেছিলাম। ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে আমি খারাপ অর্থে কথাটা বলিনি। বুঝাতে চেয়েছি আমার ঘরের সব দায়িত্ব বউমার উপরেই থাকবে।’
আব্দুর রশিদ মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি কি এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ করেছি, বেয়াই সাব?’
‘নাহ, আপনি কোনও অভিযোগ করেননি। তবে সিদ্দিকের মা সেদিন কথাটা শুনে খুব রাগ করেছিল। পরে আমারও মনে হয়েছে ভুল বলেছি।’
‘মেয়েদের বিয়ের পর অবশ্যই সংসারের কাজকর্ম করতে হবে। এটা তো চিরন্তন সত্য। আমার মেয়েও আলহামদুলিল্লাহ লক্ষ্মী। সে সব সামলে নিতে পারবে।’
‘আর আমাদের কোনও দাবি-দাওয়া নেই। এমনকী মেয়েকে গয়না না দিলেও সমস্যা নেই। আমরাই সব দিয়ে মেয়ে সাজিয়ে আনব।’
‘এ তো আপনাদের মহত্ত্ব। তবে আমার একটা মাত্র মেয়ে। আমি সাধ্যমত মেয়েকে সবকিছুই দেব।’
‘ঠিক আছে। মেয়ের বাবার মনে আমরা কষ্ট দিতে চাই না। আর দেনমোহর আপনি যা ঠিক করবেন তাই। আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’
আব্দুর রশিদ ছেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, ‘এরা কত বড় বাড়ির মানুষ বুঝতে পেরেছ? পারলে এদের একবার সালাম করে দোয়া নিয়ো, জীবনে কাজে লাগবে।’
কথাবার্তা চলছে। হঠাৎ রনি বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করল। সিদ্দিকুর নীচে গিয়েছে। সিদ্দিকুরের বাবা বাথরুমের কথা শুনে বললেন, ‘ভিতরে গিয়ে ডানদিকের মাথায় বাথরুম। নতুন টাইলস লাগিয়েছি। যাও।’
.
রনি ডানদিকে হাঁটতে লাগল। মনে হচ্ছে দোতলাতে তেমন কেউ থাকে না। বড়- বড় অনেকগুলো রুম। কিন্তু বেশিরভাগই তালাবদ্ধ। ঠিক বাথরুমের পাশের রুমটার সামনে গিয়ে রনি থমকে দাঁড়াল। রুমের দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছে। কিন্তু মনে হচ্ছে ভিতর থেকে কারও কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেমন যেন কৌতূহল হতে লাগল রনির। রুমের জানালাটা আলতো করে ধাক্কা দিল খুলে গেল সেটা। ভিতরটায় ঈষৎ অন্ধকার। বোঝা যাচ্ছে অনেক বড় একটা রুম। ভিতরে কোনও আসবাবপত্র নেই এবং মনে হচ্ছে রুমের মধ্যে কয়েকজন হাঁটাহাঁটি করছে।
হঠাৎ রনিকে চমকে দিয়ে একটা মেয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। পরনে লাল রঙের শাড়ি। বড় আঁচল দিয়ে মুখটা ঢাকা। রনির মনের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই।
মেয়েটা বলল, ‘বোনের বিয়ে দিতে এসেছেন?’
‘জি।’
‘মিষ্টি এনেছেন তো?’
‘জি, এনেছি। আপনি কে?’
মেয়েটা হেসে উঠল। রনির মনে হচ্ছে আঁচলের ওপাশে একটা কিশোরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘হাসছেন কেন?’
‘বিয়ে বাড়ি তো হাসিরই জায়গা।’
‘আপনি কে বললেন না তো।’
‘বলব না।’
‘ঘরের দরজায় তালা দেয়া কেন?’
‘আমি পাগল তো তাই আটকে রেখেছে।’ আবার হাসি
‘ওহ।’ রনি জানালা থেকে একটু দূরে সরে গেল। এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। মেয়েটা সিদ্দিকুর রহমানের কোনও আত্মীয়। সম্ভবত মানসিক ভারসাম্যহীন তাই ঘরে আটকে রাখা হয়েছে।
রনি বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল। মেয়েটা আবার ডেকে বলল, ‘যাবেন না। আপনার সাথে আরও কথা আছে।’
রনি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার তেমন কোনও আগ্রহ বোধ করছে না। পাগল মানুষ কখন কী করে, ঠিক নেই। মেয়েটা গলা নামিয়ে বলল, ‘সিদ্দিকের সাথে আপনার বোনের বিয়ে দেবেন না।’