অন্যায় যখন প্রতিপক্ষ
এক
মাঝে-মাঝে পরিবারের ভুল সিদ্ধান্তগুলো মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবু সামাজিক জীব হিসাবে একজন মানুষকে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। রনির একমাত্র ছোট বোন হীরা। রনির আব্বা আব্দুর রশিদ হুট করেই হীরার বিয়ে ঠিক করেছেন। বিয়ের বিষয়ে রনির মতামত জানারও প্রয়োজন বোধ করেননি। সব ঠিকঠাক করে আব্দুর রশিদ সেদিন ফোন করে রনিকে বললেন, ‘রনি, হীরার জন্য ভাল একটা পাত্র পেয়েছি। ফুলমণি গ্রামের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান।’ একটু থেমে বললেন, ‘ছেলে ইণ্টার পর্যন্ত পড়েছে। গঞ্জে নিজের চারটা দোকান আছে, বাবার জায়গা-জমিও আছে বিস্তর। দুই-দুইটা পাকা দালান আছে তাদের। গ্রামেও খুব নাম-ডাক, সিদ্দিকুরের পরিবারকে সবাই এক নামে চেনে।’
রনি বলল, ‘হীরার এমন কী বয়স হয়েছে? বিয়ে নিয়ে এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন?’
‘গত বছর যে মেয়ে ইন্টার পাশ করেছে, তার বিয়ে নিয়ে মা-বাবা চিন্তা করবে না?’ বিস্মিত গলায় আব্দুর রশিদ বললেন।
‘হীরার তো আরও পড়াশুনা করার ইচ্ছা। আমি চাই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক,’ পাল্টা জবাব দিল রনি।
আব্দুর রশিদ ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘মেয়েমানুষ অনেক পড়াশুনা করেছে। আর দরকার নেই। আমার মেয়ে শহরে গিয়ে মডার্ন মেয়ে হয়ে ঘুরবে, এটা আমি মেনে নিতে পারব না।’
‘আব্বা, ছেলেও তো তেমন ভাল না। পড়াশুনা তেমন করেনি, শুধু টাকা- পয়সা দেখেই রাজি হলেন?’
আব্দুর রশিদ রেগে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, ‘তোমার মতামত চাওয়ার জন্য আমি ফোন করিনি। আমার মেয়ের জন্য কোনটা ভাল, মন্দ, আমি বুঝব। তোমার এত মাথা ঘামাতে হবে না।’
‘ঠিক আছে, আব্বা।’
‘আগামী মাসের দুই তারিখে হীরার গায়ে হলুদ। তিন তারিখ বিয়ে। তুমি অবশ্যই আগে-ভাগে চলে আসবে।’
‘বড় ভাই হিসেবে আমার মতামতের যখন কোনও গুরুত্ব নেই, তখন আমি না আসলে কি কোনও ক্ষতি হবে?’
‘লাভ-ক্ষতির হিসাব আমাকে বোঝাবে না। আসবে কি আসবে না তোমার বিবেচনা।’
আব্দুর রশিদ ফোন রেখে দিলেন। পুরো বিষয়টা এখনও ঠিকমত মনের ভিতর সাজাতে পারেনি রনি। ঠিক সেই মুহূর্তে হীরা ফোন করল।
রনি ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে হীরার কান্নার শব্দ শুনতে পেল।
রনি চমকে উঠে বলল, ‘কী হয়েছে, হীরা?’
‘আব্বা আমার বিয়ে ঠিক করেছে, শুনেছ?’
‘হ্যাঁ, শুনেছি।’
‘আমি এখন বিয়ে করব না, ভাইয়া।’
রনি কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার মতামতের কোনও গুরুত্ব পরিবারে নেই। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল, ‘কাঁদিস না। কেঁদে কোনও লাভ নেই।’
‘ভাইয়া, ভাইয়া, আমাকে বাঁচাও। আমি আরও পড়ালেখা করব।’
‘ধুর, বোকা। বিয়ে নিয়ে এত ভয় পাওয়ার কী আছে?’
‘আমি পড়ালেখা করতে চাই।’
দেখবি তোর বরই তোকে পড়ালেখা করাবে।’
‘না, করাবে না। লোকটা আমার চেয়ে বারো-তেরো বছরের বড়। তার বাবা বলেছে, আমার বউ না, একটা কাজের মেয়ে দরকার। ঘরের সবকিছু বাড়ির বউকেই সামলাতে হবে।’
‘এরপরেও আব্বা এই বিয়েতে রাজি হলেন?’
‘হ্যাঁ। আব্বারও মেয়েদের নিয়ে একই ধারণা। এ ছাড়া তিনি আমাকে একটা শিক্ষা দিতে চান। ‘
‘মানে? কী শিক্ষা?’
‘তুমি তো আনিস ভাইয়ার ব্যাপারটা জানতে। আব্বা আনিস ভাইয়ার ব্যাপারটা জানার পর তড়িঘড়ি করে বিয়ে ঠিক করেছেন।’
রনির মনে পড়ল। আনিস তাদের গ্রামেরই ছেলে। ওর চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। এখন ঢাকা কলেজে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। অনেক আগে থেকেই আনিস হীরাকে পছন্দ করে। হীরারও তার প্রতি আগ্রহ আছে। আনিস বলেছে একটা চাকরি জোগাড় করে হীরার বাসায় প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু আব্দুর রশিদ এই বিষয়টা জানতে পেরে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। তাঁর মেয়ের নিজ পছন্দে বিয়ে হবে, এটা তিনি চিন্তাও করতে পারেন না। ছেলে রাজপুত্র হলেও সেই বিয়ে তিনি মানবেন না।
ভাবলেশহীন গলায় রনি বলল, ‘আব্বার বিষয়ে কী আর বলব! তুই একটা ছেলেকে পছন্দ করিস তাতেই আব্বা এমন করছে। আর যদি প্রেম করতি, তা হলে মনে হয় মেরেই ফেলত।’
হীরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, ‘ভাইয়া, আমি এখন কী করব?’
‘সাহস থাকলে পালিয়ে যা।’
‘সাহস নেই। আর পালিয়ে কোথায় যাব?’
‘আনিস কী বলে?’
‘তিনি তো খুব আঘাত পেয়েছেন। তাঁর বাবাকে দিয়ে আব্বার সাথে কথা রলানোর চেষ্টা করেছিলেন। আব্বা তাঁর সাথে ঠিকমত কথা তো বলেনইনি, উল্টো খুব অপমান করেছেন।’
‘আচ্ছা, দেখি আমি কী করতে পারি।’
‘তুমি দ্রুত বাসায় চলে এসো, ভাইয়া।’
‘আচ্ছা, আসব।’
‘আমার মন বলছে তুমি এলে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।’
দুই
দেরি করতে ইচ্ছে হলো না রনির। হীরার ফোন পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করল। বোনের এই সমস্যায় হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। রনি গ্রামে যাওয়ার পর আব্বার হাসিমুখ দেখতে পেল। রনিকে দেখে তিনি বললেন, ‘ভাল সময়ে এসেছ। কাল সিদ্দিকদের বাসায় যাওয়ার কথা আছে। তোমাকে নিয়ে যাব।’
সিদ্দিকের সঙ্গে হীরার বিয়ে হতে যাচ্ছে।
রনি বলল, ‘আব্বা, আমি যাব না।’
মুহূর্তেই আব্দুর রশিদের মুখ কালো হয়ে গেল। বললেন, ‘কেন যাবে না?’
‘আব্বা, ছেলের বয়স তো অনেক বেশি। আমার চেয়েও চার-পাঁচ বছরের বড়।’