আনোয়ার কয়েক পা পিছনে সরে গেল। ‘আ-আপনি?’
কোনও উত্তর নেই। সুলেখা মিত্র শুধু একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টি কোনও জীবিত মানুষের হতে পারে না।
‘কী চান আপনি?’
এবারও কোনও উত্তর নেই। আনোয়ার দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে দিল। সম্ভবত সে ভুল দেখছে। তার মস্তিষ্ক কোনও ধরনের খেলা খেলছে। আবার সেই পুরানো ভয়টা ফিরে এল আনোয়ারের। মনের ভিতর কাজ করছে তীব্র অপরাধবোধ। এক নিঃশ্বাসে দুই গ্লাস পানি খেল আনোয়ার। আবার ধীরে- ধীরে ছাদের দিকে উঁকি দিল। না, কেউ নেই সেখানে। কিন্তু আনোয়ার জানে সুলেখা আবার আসবে।
সে রাতে আর ঘুম হলো না ওর। সারারাত এপাশ-ওপাশ করল। কয়েকবার মনে হলো কে যেন দরজায় মৃদু শব্দ করছে। ছাদে দ্রুত গতিতে কেউ যেন হাঁটছে। কয়েকবার বাইরে বেরিয়েও আনোয়ার কাউকে দেখতে পেল না। দূরে কোথায় যেন একটা পাখি ডেকে উঠল।
.
সেই রাতের পর থেকে আনোয়ারের জীবনে হঠাৎ যেন দুর্যোগ নেমে এল। প্রতি রাতে সুলেখা ওর কাছে আসতে থাকে। কোনও-কোনও রাতে আনোয়ার ঘুম ভেঙে সুলেখাকে ওর বিছানায় দেখতে পায়। মাঝে-মাঝে চিৎকার করে ওঠে আনোয়ার। কখনও প্রচণ্ড ছটফট করতে থাকে। তখন সুলেখা চলে যায়।
সুলেখা আনোয়ারের সঙ্গে কোনও কথা বলে না। শুধু বিকৃত মুখমণ্ডল নিয়ে আনোয়ারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই তাকিয়ে থাকার মধ্যেই অনেক কথা লুকিয়ে থাকে। তার কিছুটা আনোয়ার ঠিকই বুঝতে পারে।
সেদিন রাতে সাহসে ভর করে আনোয়ার বলল, ‘কী চান আপনি?’
সুলেখা বিড়বিড় করে কিছু বলল। বোঝা যাচ্ছে ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
আনোয়ার কাছে গিয়ে শোনার চেষ্টা করল। সুলেখা আবার বলল, ‘ক-কষ্ট অ-অ-অনেক ক-কষ্ট।’ রক্তের স্রোত যেন তুমুলবেগে নেমে এল সুলেখার মাথা আর মুখ দিয়ে। পানির একটা ধারাও গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে। আনোয়ার বুঝতে পারল সুলেখার কাছ থেকে মুক্তি পেতে হলে ওকে কী করতে হবে।
.
পর-পর তিন রাত না ঘুমিয়ে আনোয়ার কেমন যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে মাথার উপর রয়েছে অসহ্য চাপ। নিজেকে খুব অসহায় লাগতে থাকে ওর। সেই সাথে চলতে থাকে বিবেকের দংশন। আনোয়ার একটা সত্য সবার কাছ থেকে গোপন করেছে। সুলেখা আত্মহত্যা করেনি, ওর স্বামী সুনীল ওকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আনোয়ার সেদিন রাতে পাশের ছাদ থেকে পুরো দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল। সুনীল সুলেখাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেই দৌড়ে নীচে চলে গিয়েছিল। পাশের ছাদ থেকে যে আনোয়ার ওদের দেখেছে এটা সুনীল জানে না। আর সেদিন আনোয়ারদের ছাদের বাতি ছিল নেভানো। তাই সুনীল ধারণা করেছে খুব সুচারুভাবে ও খুনটা করেছে। আসলে তা নয়। সুনীল জানে ওর যেটুকু ক্ষমতা তাতে বিষয়টা সহজেই আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করা যাবে। আর কোনও প্রত্যক্ষদর্শী থাকার তো প্রশ্নই নেই। তাই ওর কোনও শাস্তি হবে না। আর সুলেখা যে মানসিক রোগী ছিল এ সংক্রান্ত ভুয়া কাগজপত্রও সুনীল জোগাড় করেছে। পুলিসও তদন্তে খুশি। সত্যি বলতে, সুনীল তাদের খুশি করে দিয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই পুলিস রিপোর্ট দেবে, সুলেখা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। তাই সে আত্মহত্যা করেছে।
আনোয়ার পুরো বিষয়টা জেনেও চুপ ছিল। অনেক নির্ভার থাকার চেষ্টা করেছে। কারণ ও সুনীলের ক্ষমতা সম্পর্কে জানে। তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গেলে ওর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে যাবে। আর তার সাক্ষ্যতে আদৌ কিছু হবে কি না, এ ব্যাপারেও সে সন্দিহান। তবুও নিজের কাপুরুষতা বারবার আনোয়ারের বিবেককে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সুলেখা সুবিচার চাইতেই হয়তো বারবার ওর কাছে আসে। আনোয়ার এসব থেকে মুক্তি চায়। কাপুরুষ হিসাবে ও বাঁচতে চায় না। আনোয়ার ঠিক করল পুলিসের কাছে সে সব কিছু বলবে।
.
ছাদে দাঁড়িয়ে কেয়াকে সব খুলে বলল আনোয়ার। তার মত শক্ত চরিত্রের মানুষ কথা বলতে-বলতে হঠাৎ কেঁদে উঠল। বড্ড মায়া হলো কেয়ার। শক্ত করে জড়িয়ে রাখল আনোয়ারকে। কেয়া বলল, ‘আপনি, প্লিজ, শান্ত হোন। আমি আপনার পাশে আছি।’
আনোয়ার বলে, ‘আমি একজন মানুষের উপর অবিচার করেছি। একজন খুনির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনি।’
‘শুধু আপনি নন, অন্য যে-কোনও মানুষই এমন করত। আর সময় তো এখনও চলে যায়নি। আমি খেয়াকে বলেছি থানায় ফোন করতে। পুলিস কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। আর এই যুদ্ধে আমি সবসময় আপনার পাশে আছি।’
কেয়া আবার বলল, ‘আপনার তো অনেক জ্বর। ইস্! চলুন, মাথায় পানি ঢালতে হবে।’
আনোয়ার বাধ্য ছেলের মত গেল। বিছানায় শুয়েই চোখ বন্ধ করল সে।
কত সময় পার হয়েছে জানে না আনোয়ার। হঠাৎ চোখ মেলে দেখল কেয়া ওর মাথায় পানি ঢালছে। একটু দূরে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ারের বাবা। আনোয়ার একটা ঘোরের মধ্যে আছে। সে সুলেখাকেও দেখতে পেল। লাল একটা শাড়ি পরেছে সুলেখা। কী সুন্দর করে সেজেছে ও! বিকৃত শরীরেও এখন তাকে সুন্দর লাগছে।
পুলিসের গাড়ির সাইরেন শুনতে পেল আনোয়ার। আবার ওর চোখ বন্ধ হয়ে এল।
বারবার চোখ মেলে কেয়ার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে আশ্বস্ত হলো আনোয়ার। ও জানে এমন একটা মায়াবী মুখ ওকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।