‘কেয়া, তুমি আর খেয়া কিছুক্ষণের জন্য ছাদে আসতে পারবে?’
‘কেন, আনোয়ার ভাই? হঠাৎ?’
‘একটু দরকার ছিল। খুব সমস্যা থাকলে আসার দরকার নেই। ‘
‘না, কোনও সমস্যা নেই। বাবাও বাড়িতে নেই। আমরা দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।’
আনোয়ার আয়েশ করে সিগারেট ধরাল। আজ ওর মনটা বেশ ভাল। একটা রহস্যের সমাধান ও করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে।
কেয়া-খেয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাদে চলে এল। এই অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে দুই বোন। আনোয়ারের ঘরে চেয়ারে বসল ওরা। কেয়া বলল, ‘কী, আনোয়ার ভাই। হঠাৎ জরুরি তলব?’
‘ভাল আছ তোমরা?’
‘হ্যাঁ, ভাল। আপনি তো কখনও ফোন করেন না। আজ হঠাৎ ফোন করে ছাদে আসতে বললেন?’
‘আমি ভণিতা পছন্দ করি না। তাই সরাসরি কিছু কথা বলতে চাই।’
আনোয়ারের কথা বলার ভঙ্গি দেখে ওরা দু’জনে চুপ হয়ে যায়। কিছু একটা আন্দাজ করে।
‘এটা কেন করলে তোমরা?’
‘কী করেছি?’ কেয়া মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘সুলেখা সেজে আমার সাথে কেন এমন করলে?’ দু’জনের মাথা নিচু হয়ে যায়।
‘উত্তর দিচ্ছ না কেন?’
‘আমরা আসলে আপনাকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছি।’
‘কেন?’
‘আপনি নিজেকে অনেক সাহসী ভাবেন। আসলেই সাহসী কি না সেটা দেখার জন্যই এমন করেছি।’
‘আমি প্রথম রাতে বুঝতে না পারলেও গতকাল রাতে হিসাব মেলাতে পেরেছি। প্রথম দিন কেয়া এসেছিল, আর দ্বিতীয় দিন খেয়া। ঠিক?’
‘কী করে বুঝলেন?’ পাল্টা প্রশ্ন কেয়ার।
‘কেয়া, তোমার হাতে নীল রঙের নেলপালিশ। আর খেয়ার হাতে লাল রঙের নেলপালিশ। আমি তোমাদের হাতের দিকে লক্ষ্য করেছিলাম।’
কথাগুলো শুনে কেয়া-খেয়া নিজেদের হাত ঢেকে ফেলল।
আনোয়ার আবার বলল, ‘তোমরা গায়ে এমন কোনও সুগন্ধি লাগিয়েছিলে, যেটা আমার চেতনার জগৎ ওলট-পালট করে দিয়েছিল। আমি সহজভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না। এজন্য ভয়টাও বেশ জেঁকে ধরেছিল। এই সুগন্ধি তোমরা পেলে কোথায়? আমার তো মনে হয় এটি নিষিদ্ধ কোনও সুগন্ধি। আর এটা শুধু ছেলেদের উপরই কাজ করে। আমি কি ঠিক বলেছি?’
‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। অনলাইনে একটা ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেখে আমরা অর্ডার দিয়েছিলাম। তারা গোপনে আমাদের বাসায় দিয়ে গেছে। ওটা ছেলেদের আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করা হয়।’
‘ওই সুগন্ধি এতটাই প্রখর ছিল যে আমি ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছিলাম না। আমি গলার স্বর শুনেও তাই তোমাদের চিনতে পারিনি। আচ্ছা, আমাকে ভয় দেখানো কি এতটাই জরুরি?’
কেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আর খেয়ার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়।
কেয়া কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘আমরা শুধু মজা করতে চেয়েছিলাম। প্লিজ, আমাদের মাফ করে দিন।’
কেয়ার জন্য মায়া হয় আনোয়ারের। ইচ্ছা করে মাথায় একটু হাত রাখতে। ইচ্ছাটাকে দমন করে আনোয়ার হাসল। এরপর বলল, ‘আমি রাগ করিনি। কান্না থামাও। বিষয়টা চিন্তা করে এখন বেশ মজাই লাগছে। তবে ঘটনার এখানেই ইতি ঘটাও। আর এসব কোরো না।’
দুই বোন মাথা নাড়ে। খেয়া নীচে চলে গেল। কেয়া বিছানায় বসেই থাকল। এখনও চোখে পানি ওর।
আনোয়ার আবার বিব্রত হলো। হঠাৎ বলল, ‘কেয়া, আমি একটু অন্যরকম। সৌন্দর্য বিষয়টা ভাল বুঝি না। কিন্তু তোমার কান্না দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গের কোনও দেবী কাঁদছে। আমার ইচ্ছা করছে…’
কেয়ার কান্না পুরোপুরি থেমে গেল। চোখ বড়-বড় করে তাকাল আনোয়ারের দিকে। তারপর বলল, ‘কী ইচ্ছা করছে?’
‘নাহ। কিছু না।’
‘বলুন। বলতে হবে।’
‘তোমার চোখের পানি মুছে দিতে ইচ্ছা করছে।’
কেয়া দ্রুত এগিয়ে গেল। ‘দিন, চোখের পানি মুছে দিন।’
‘চোখে তো এখন পানি নেই!’
‘তা হলে কি আমাকে আবার কাঁদতে হবে?’
এ সময় খেয়া দৌড়তে দৌড়তে ছাদে এল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘আপা, বাবা বাসায় এসেছে। তাড়াতাড়ি চলো।’
কেয়া-খেয়া দু’জনেই দৌড় দিল।
.
আজ সারাদিন বাইরে ঘুরে কাটিয়েছে আনোয়ার। নীলখেত থেকে কিছু বই কিনল। এক বন্ধুর সাথে পুরান ঢাকার রহস্যময় একটা বাড়ি নিয়ে আলাপ হলো, আনোয়ার সেখানে যেতে চায়। ওর বন্ধুও খুব আগ্রহ দেখাল। টিএসসি-তে গিয়ে কিছুক্ষণ একা-একা বসে রইল আনোয়ার। কয়েক বছর আগেও সে ঢাবির ছাত্র ছিল। এখন এখানের কাউকেই সে চেনে না।
রাত ৮টার দিকে বাসায় ফিরল আনোয়ার। প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। বাসায় ঢুকেই পেট ভরে খেয়ে নিল ও। এরপর সোজা ছাদে। আকাশটা আজ বেশ পরিষ্কার। বাইরে বেশ বাতাস বইছে। আনোয়ার চিলেকোঠার ঘরে বসে একটা রগরগে ভূতের বই পড়ছে।
রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। আশপাশের শব্দ কমে গেছে একদম। হঠাৎ ছাদে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেল আনোয়ার। পা টেনে-টেনে হাঁটার খস খস শব্দ। রুম থেকে বেরিয়ে আনোয়ার দেখতে পেল বোরকা পরা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। কেয়া-খেয়া আবার ওকে ভয় দেখাতে এসেছে? মেজাজটা চরম খারাপ হলো ওর। এগিয়ে গেল ওদিকে।
আনোয়ার জোরে বলল, ‘তোমরা পেয়েছ কী? আবার ভয় দেখাতে এসেছ?’
বোরকা পরা মেয়েটি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। আনোয়ারের কথায় তার কোনও ভ্রুক্ষেপ হলো না। আনোয়ার দ্রুত এগিয়ে গেল ওদিকে। টেনে মেয়েটাকে চোখের সামনে নিয়ে এল। এরপর টান দিয়ে নেকাব খুলে ফেলল। আজ একটা হেস্তনেস্ত ও করবেই।
নেকাব সরিয়ে আনোয়ার যেন পাথরের মত জমে গেল। সুলেখা মিত্র দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা একদিকে বেঁকে আছে, মাথার সামনে থেঁতলানো। ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। মুখটা অল্প খোলা। লালা ঝরছে সেখান থেকে।