আনোয়ারের বাবা আর বিয়ে করেননি। তিনি আনোয়ারকে নিজের মত করে বড় হতে দিয়েছেন, একই সাথে দিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। এ জন্য ছেলেটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। ঘর-বাড়ি ছেড়ে প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ভূত-প্রেতের সন্ধান করে। মাস্টার্স পাশ করে চাকরির কোনও চেষ্টাও করছে না। চেহারায় একটা পাগলের ভাব চলে এসেছে। তাই নার্গিস জাহান এখন আর আনোয়ারের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে তেমন আগ্রহী নন। তবে আনোয়ারের প্রতি তিনি আগের মতই প্রবল মমতা বোধ করেন। সপ্তাহে একদিন আনোয়ারকে না দেখে তিনি থাকতে পারেন না। তিনি যখন আনোয়ারের বাবার কাছে শুনলেন আনোয়ার ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে আছে, কেঁপে উঠেছে তাঁর বুকটা। মেয়েকে নিয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ ক্লিনিকে ছুটে এসেছেন। তাঁর মেয়ে নাদিয়া আনোয়ারের সেবা- যত্নের জন্য কষ্টের চূড়ান্ত করছে। নার্গিস জাহানের মনে সন্দেহ জেগেছে যে, নাদিয়ার হয়তো আনোয়ারের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। এই বয়সে মেয়েরা ভুল মানুষকে পছন্দ করে বসে।
আনোয়ার চোখ মেলে তাকাল। রহস্যের সন্ধানে সারা দেশ ঘুরে বেড়ায় সে। বিষয়টা ধীরে-ধীরে পরিণত হয়েছে তীব্র নেশাতে। রাঙামাটির এবারের ট্যুরটা কঠিন ছিল ওর জন্য। খাওয়া-দাওয়া, ঘুমের ঠিক ছিল না। মাথার উপর ছিল কড়া রোদ। হেপাটাইটিস ভাইরাসটা শরীরে হয়তো অনেকদিন ধরেই বাসা বেঁধে ছিল। এবার সে তার চূড়ান্ত রূপ দেখাল।
আনোয়ারের সামনে সব কেমন যেন হলুদ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, সে যেন হলুদ সর্ষে খেতের মধ্য দিয়ে হাঁটছে। বহুদূরে একটা মেয়েকে দেখতে পেল সে। মেয়েটার পরনে সবুজ শাড়ি। হলুদের মধ্যে সবুজটা দেখতে ভালই লাগছে।
মেয়েটা হঠাৎ বলল, ‘আনোয়ার ভাইয়া, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?’
আনোয়ার হাসার চেষ্টা করল। ‘হ্যাঁ।’
‘বলুন তো আমি কে?’
‘তুমি কেয়া।’
‘ভুল বললেন। আমি কেয়া নই। নাদিয়া। আপনার খালাতো বোন।’
‘ও। হ্যাঁ, তুমি নাদিয়া। চিনতে পেরেছি।’
‘বলুন তো আমি কী পড়ছি?’
‘তুমি এবার এস.এস.সি. দিয়েছ।’
‘না। আমি এবার অনার্স সেকেণ্ড ইয়ারে। আচ্ছা থাক, আপনার আর কথা বলার দরকার নেই। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’
‘ছোটবেলায় আমি তোমার একটা পুতুল ভেঙে ফেলেছিলাম। তুমি খুব কেঁদেছিলে।’
‘সে তো অনেক আগের কথা।’
‘শাড়িতে তোমাকে সুন্দর লাগছে।’
‘আনোয়ার ভাই, প্লিজ, আর কথা বলবেন না। আমি শাড়ি পরিনি। সালোয়ার-কামিজ পরে আছি।’
একটু পর ডাক্তার দেখতে এল আনোয়ারকে।
ডাক্তারদের চোখ-মুখ সাধারণত অনুভূতিশূন্য হয়। কিন্তু এই ডাক্তারের চেহারা তেমন নয়।
ডাক্তার নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রোগীর তো নিজেকে নিয়ে কোনও চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। লিভারের কণ্ডিশন খুব খারাপ।’
নাদিয়া থতমত খেয়ে বলল, ‘কী বলছেন এসব?’
ডাক্তার আনোয়ারের ফাইলটা দেখতে-দেখতে বলল, ‘এখন থেকে খুব নিয়ম মেনে চলতে হবে। খাবার-দাবার, চলাফেরায় খুব সচেতন থাকতে হবে। পাঁচ দিন আগে যখন আনোয়ার সাহেবকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো, আমরা তো তাঁকে নিয়ে বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে।’
নাদিয়ার ভয়ার্ত চোখ একটু স্বাভাবিক হয়ে এল।
ডাক্তার আবার বলল, ‘নিয়ম মেনে না চললে এই জণ্ডিস বারবার ফিরে আসবে। এরপর হয়তো আমাদের কিছু করার থাকবে না। এমনকী লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।’
আনোয়ার মন দিয়ে ডাক্তারের কথা শুনছিল। লোকটার কথার মধ্যে কোথায় যেন একটু মায়ার ছোঁয়া আছে। সে চোখ মেলে বলল, ‘ডাক্তার সাহেব, আমার কিছু হবে না।
ডাক্তার ধমক দিয়ে বলল, ‘আপনি চুপ করুন। আর একটু হলে তো মরতে বসেছিলেন। শরীরের যত্ন নিতে শিখুন।’
আনোয়ার হাসার চেষ্টা করল।
ডাক্তার বলল, ‘আপনি কী করেন, জানতে পারি?’
‘আমি আসলে বেকার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাই।’
‘পর্যটক?’
নাদিয়া বলল, ‘আনোয়ার ভাই রহস্য, ভূত-প্রেত এসবের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান। বিভিন্ন ধরনের মন্ত্র, দোয়া-দরূদ তাঁর মুখস্থ।’
ডাক্তার চোখ কপালে তুলে বলল, ‘বলেন কী? …আচ্ছা, আনোয়ার সাহেব, ভূত বলে সত্যি কিছু আছে? আপনি কি কখনও দেখেছেন?’
আনোয়ার আবার হাসল। বুঝিয়ে দিল তার উত্তর দেয়ার ইচ্ছা নেই।
‘শুনুন, আনোয়ার সাহেব, ভূতের পিছনে ছোটা বাদ দিয়ে একটা চাকরি করুন। একটা ভাল মেয়েকে বিয়ে করুন। আবার অনিয়ম করলে কিন্তু আপনি মারা যাবেন। কে জানে, হয়তো ভূতই হয়ে যাবেন। হা-হা-হা!’
এই লোকের হাসিটা প্রাণখোলা। ডাক্তারের এমন প্রাণখোলা হাসি দেখলে অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায় রোগী।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আনোয়ারকে স্যুপ খাইয়ে দিতে শুরু করল নাদিয়া।
আনোয়ার লজ্জিত গলায় বলল, ‘আর দিয়ো না। বমি আসছে। শেষে হয়তো দেখা গেল তোমার গায়ে বমি করে দিয়েছি।
নাদিয়া বলল, ‘গত পাঁচ দিনে আপনি আটবার আমার গায়ে বমি করেছেন। আরও একবার করলে সমস্যা নেই।’
আনোয়ার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার সাহেবের কথা হঠাৎ ওর মাথায় চেপে বসল। নাদিয়ার মত এক মেয়েকে বিয়ে করলে মন্দ হয় না।
তিন
সেজান পাশের ফ্ল্যাটের রহমত আলীর ঘরে বসে আছে। চোখ-মুখ শুকনো। বুকের ভিতরটা কোনও কারণ ছাড়াই টিপ-টিপ করছে। মাথার চাপা ব্যথাটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।