‘মানে? কী বলছেন এসব? মজা করছেন?’
‘আপনার সাথে আর কথা বলব না। এখন আমাকে যেতে হবে। আপনি চোখ বন্ধ করুন।’
‘চোখ বন্ধ করব মানে?’
‘আমাকে যেতে হবে। সময় বেশি নেই। ওই যে দেখুন আকাশে কিছু একটা আসছে। সময় বেশি নেই।’
আনোয়ার আকাশের দিকে তাকায়। কিছু দেখতে পায় না। কয়েক মুহূর্ত পর পিছনে তাকিয়ে আনোয়ার দেখে মেয়েটা নেই।
সকালে ঘুম ভাঙার পর আনোয়ার ছাদে পায়চারী করতে থাকে। পাশের বাসা থেকে বেশ হইচই শোনা যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে ওই বাড়ির কোনও এক মেয়ে মারা গেছে। আনোয়ারের সঙ্গে আশপাশের মানুষের খুব বেশি পরিচয় নেই। তাই সে ঠিক জানে না কে মারা গেছে। কেয়া-খেয়ার সঙ্গে কথা বললে অবশ্য জানা যেত।
সকাল ১১টার দিকে কেয়া ছাদে আসে। ওর হাতে আচারের বয়াম। আচারগুলো রোদে দিল কেয়া। আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। ‘আনোয়ার ভাই, কেমন আছেন?’
‘এই তো, কেয়া, ভালই আছি।’
‘আপনার ঘোরাঘুরি কেমন চলছে?’
‘এই তো ভালই।’
‘এই যে আপনি ভূত-প্রেত খুঁজে বেড়ান, দেশের নানা জায়গায় যান, আপনার ভয় লাগে না?’
আনোয়ার হাসল। এরপর বলল, ‘মজা লাগে। অনেক মজা।’
‘আমাকে একবার আপনার সাথে নেবেন?’
‘অবশ্যই।’
‘আমার মাঝে-মাঝে কী ইচ্ছা করে জানেন? দূরে কোনও দ্বীপে চলে যেতে। যেখানে প্রকৃতির মাঝে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারব।’
আনোয়ার হেসে বলল, ‘আশা করি তোমার ইচ্ছা একদিন পূরণ হবে।’
‘আপনি এমন করে হাসলেন কেন?’
‘সত্যি কথাটা কি জানো, আমাদের সবারই দূরে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ইচ্ছাপূরণ হওয়ার পর দেখবে, বেশিদিন একা-একা ভাল লাগছে না।’
কেয়া জোর দিয়ে বলল, ‘আমার লাগবে।’
‘আচ্ছা মেনে নিলাম।’
তাদের কথোপকথনের এই পর্যায়ে পুলিসের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। আনোয়ার ছাদ থেকে নীচের রাস্তায় তাকাল। ওদের পাশের বাড়িতে পুলিস এসেছে।
আনোয়ার বলল, ‘কী ব্যাপার, হঠাৎ পুলিস কেন?’
‘আপনি কোন্ দুনিয়ায় থাকেন? কিছু জানেন না?’
‘না তো। কী হয়েছে?’
‘পাশের বাসার এক বৌদি দু’দিন আগে আত্মহত্যা করেছে।’
‘কীভাবে আত্মহত্যা করেছেন?’
‘ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল। মাথা থেঁতলে গেছে। খুব বিশ্রীভাবে মারা গেছে। পুলিস তার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।’
‘যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম কী?’
‘সুলেখা বৌদি।’
আনোয়ার ভিতরে-ভিতরে বেশ চমকে উঠল। হঠাৎ বলল, ‘কাল রাতে কি তুমি বা খেয়া কেউ ছাদে এসেছিলে?’
‘রাতে! কী বলছেন এসব? রাত তো অনেক দূরের কথা, বাবা দিনের বেলাই ছাদে আসতে দিতে চান না। তো আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন করছেন কেন?’
‘না, এমনি।’
‘সুলেখা বৌদির স্বামী অনেক ক্ষমতাবান মানুষ। সুনীল কুমার বিশ্বাস। চেনেন তো তাকে? পুলিস, আণ্ডারওয়ার্ল্ডের মানুষ সবার সাথে তার ভাল সম্পর্ক। তাই এই আত্মহত্যায় তার কোনও ভূমিকা থাকলেও দেখবেন শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না।’
‘এটা আত্মহত্যা না হত্যা?’
‘আমি কী করে বলব বলেন। তবে আত্মহত্যাই মনে হয়। আত্মহত্যা হোক আর যা-ই হোক সুনীলের অত্যাচারেই নিশ্চয় এটা ঘটেছে।’
‘হুম।’
কেয়া চলে গেল। আনোয়ারের মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেল। সারাদিন বাসায় কাটাল সে। আর রাতের খাবার শেষ করে ছাদের এক কোনায় বসে রইল। কিছু একটা নিয়ে বড্ড চিন্তিত সে বোঝা যাচ্ছে। রাত ১১টা ৪০ মিনিট। হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধ পেল আনোয়ার। পিছনে ফিরে দেখল বোরকা পরা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আনোয়ার দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
‘ভাল আছেন?’ মেয়েটির সরল জিজ্ঞাসা।
‘কে, কে আপনি?’ আনোয়ারের কণ্ঠে কিছুটা উত্তাপ।
‘আগের দিন তো বলেছি আমি সুলেখা।’
‘আমি বিশ্বাস করি না। আপনার মুখ দেখান।’
‘আপনি ভয় পাবেন।’
‘না, আমি ভয় পাব না।’
‘আপনি এখনই ভয় পাচ্ছেন। আপনার শরীর কাঁপছে।’
আনোয়ার আসলেই খুব ভয় পাচ্ছে। সে তো এত ভীতু নয়। তবে আজ কেন এমন হচ্ছে?
‘আপনি আমার কাছে কী চান?’
‘কিছু না। আপনার সাথে গল্প করতে চাই।’
‘আপনি চলে যান।’
‘বেশি কথা বলবেন না। চুপ করে বসুন। বেশি কথা আমার ভাল লাগে না।’ হঠাৎ হিংস্র গলায় বলল সুলেখা।
আনোয়ার বসে পড়ল।
‘আমি আপনাকে নিয়ে যেতে চাই,’ সুলেখা বলল। ‘মানে?’
‘আমার বড্ড একা লাগে। আপনাকে আমার চাই।’
আনোয়ারের মুখ আরও শুকনো হয়ে যায়। হেসে ওঠে সুলেখা। আনোয়ারের মনে হয় পরিচিত হাসি। কিন্তু সুলেখার হাসি তো ও আগে শোনেনি। সুলেখার হাতের দিকে চোখ যায় ওর। শক্ত করে কিছু ধরে রেখেছে সুলেখা। আনোয়ার বুঝতে পারে ওটা একটা ছুরি। ছাদে জ্বলতে থাকা বাল্বের মৃদু আলোতে হাতের লাল রঙের নেলপালিশও দৃশ্যমান হয়। আনোয়ারের শরীর কেমন যেন অসাড় হয়ে যায়। সুলেখাকে খুব ভয় পাচ্ছে ও।
‘আপনাকে আজ নেব না। চিন্তা নেই, তবে একদিন ঠিকই নিয়ে যাব। যান, এখন বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’
আনোয়ার বাধ্য ছেলের মত চিলেকোঠার ঘরে যায়। লাইট জ্বেলে বিছানায় বসে পড়ে। ১০ মিনিট পর বাইরে বেরিয়ে দেখে ছাদে কেউ নেই। তবে সেই মিষ্টি গন্ধটা আছে। যে গন্ধটার জন্য বারবার ওর চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছিল।
সকাল ১০টায় ঘুম ভাঙল আনোয়ারের। রাতে বেশ ভাল একটা ঘুম হয়েছে। দ্রুত ফ্রেশ হলো আনোয়ার। বাসা থেকে কাজের ছেলে খালেদ ছাদে নাস্তা দিয়ে গেল। আনোয়ার নাস্তা শেষে কেয়াকে ফোন করল।