নীচে পড়ে থাকা চাপাতিটা তুলে নিল ফ্যাফ্যাসটা। ভয়ঙ্করভাবে কোপ দিল সুজানার বুকে। সুজানার রক্ত আর জাফরের রক্ত এক হয়ে মিশে গেল।
তীব্র গলায় বলল ফ্যাফ্যাস, ‘তুই আমার সন্তানকে বাঁচতে দিলি না! আমিও তোর সন্তানকে বাঁচতে দেব না!’
অসহ্য যন্ত্রণায় কেঁপে-কেঁপে উঠছে সুজানা। দিন-রাতের পার্থক্য ভুলে গেল সে। একটা বাচ্চার কোমল মুখ ফুটে উঠল তার চোখে। সুজানার মনে হলো, এটাই রোমি। আহা রে! কী সুন্দর ঝুঁটি করেছে মেয়েটা! চোখগুলো কেমন মায়া- মায়া! বড্ড আদর করতে ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে!
ফ্যাফ্যাস এবং সুজানার দেহ পড়ে রইল মেঝেতে। এখনও মারা যায়নি তারা। সুজানার দেহ যেমন আস্তে-আস্তে অবশ হয়ে আসছে, ঠিক তেমনি ফ্যাফ্যাসের শরীরও শীতল হয়ে আসছে।
সুজানা চোখ মেলে তাকাল। বলল, ‘হে, আল্লাহ্! আমি মারা গেলেও আমার সন্তান যেন বেঁচে থাকে। তুমি আমার সন্তানকে বাঁচিয়ে দাও।
এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তেও সুজানার কেন জানি মনে হচ্ছে, কেউ তার ঘরে আসবে। তাকে হাসপাতালে নেবে, আর বেঁচে যাবে তার সন্তান।
সুজানার মত ফ্যাফ্যাসও কাতর স্বরে ভিন ভাষায় বলল, ‘হে, অন্ধকারের দেবতা! আমার সন্তানকে রক্ষা করো! তাকে এই পৃথিবীতে স্থান দাও!’
ফ্যাফ্যাস এবং সুজানা কারও প্রার্থনাই মঞ্জুর হলো না।
ফ্যাফ্যাস, এবং সুজানা একই সময়ে চিরতরে চোখ বুজল। এক শত বিশ বছরের জন্য পৃথিবীকে রক্ষা করেছে সুজানা। আবারও এক শ’ বিশ বছর পর অন্ধকার জগৎ থেকে পেটে ডিম নিয়ে পৃথিবীতে আসবে একটা ফ্যাফ্যাস। সে তার সন্তানদের জন্য খুঁজবে পোষক দেহ। হয়তো তখন পৃথিবীতে হবে ফ্যাফ্যাসের রাজত্ব। কিংবা সুজানার মত কেউ বুক আগলে রক্ষা করবে পৃথিবীকে।
ভয়
ছাদে কি নূপুর পায়ে কেউ হাঁটছে? নাকি অন্য কোনও শব্দ? আনোয়ার নিশ্চিত হতে পারছে না। এই শীতে বিছানা থেকে উঠতেও ইচ্ছা করছে না। যদিও ছাদে উঁকি দেয়া তার জন্য সহজ। কারণ সে ছাদের চিলেকোঠায় থাকে। এই বিশাল চারতলা বাড়িটা আনোয়ারদের। কিন্তু একা-একা শান্তিতে থাকার জন্য ও ছাদের চিলেকোঠাকেই বেছে নিয়েছে। ছাদেই যেন একটা সুন্দর সংসার আছে ওর। খুব প্রয়োজন না হলে আনোয়ার ছাদ ছেড়ে বাসায়ও তেমন একটা যায় না। তাই কেউ ওর সঙ্গে দেখা করতে এলে সরাসরি ছাদেই চলে আসে।
শব্দটা বেশ মিষ্টি লাগছে। এত রাতে ছাদে কে হতে পারে? ভাড়াটিয়াদের কেউ? কেয়া বা খেয়া নয় তো? দোতলার সোবহান সাহেবের দুই মেয়ে কেয়া আর খেয়া। কেয়া ইণ্টারমিডিয়েট পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছে। আর খেয়া ক্লাস নাইনে পড়ে। দুই বোনই অসম্ভব রকমের সুন্দর। এরা প্রায়ই ছাদে আসে। সোবহান সাহেবের এ ব্যাপারটা একদম পছন্দ নয়। তাই তিনি ওদের ছাদে আসার বিষয়ে ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। তবুও দুই বোনকে প্রায়ই ছাদে দেখা যায় এবং আনোয়ারের সাথে গল্প করাই যে তাদের মূল উদ্দেশ্য এটাও বোঝা যায়। আনোয়ারও ওদের খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে কেয়াকে। পছন্দটা কোন্ পর্যায়ের এ ব্যাপারে আনোয়ার নিশ্চিত নয়। কেয়ার সাথে কথা বলতে ওর খুব ভাল লাগে এটুকুই ও জানে।
রাত ১টা ৫৫। এত রাতে কেয়া-খেয়ার যে-কারও ছাদে আসার সম্ভাবনা শূন্য। আর নূপুর পরে হাঁটার কথা তো চিন্তাই করা যায় না। আনোয়ার দরজা খুলে ছাদে এল। নূপুরের শব্দটা ক্ষীণ হয়ে আসে। তবে চমৎকার একটা ঘ্রাণ পায় আনোয়ার। আর মৃদু বাতাসে যেন শরীর জুড়িয়ে আসে। এমন কি হতে পারে ছাদে অশরীরী কিছু আছে? এমন হলে মন্দ হয় না। আনোয়ার এসব জিনিস দেখার জন্য অনেক অ্যাডভেঞ্চার করেছে। কত অদ্ভুত অভিজ্ঞতার যে মুখোমুখি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
আনোয়ারদের ছাদটা বেশ বড়। অনেক সুন্দর করে সাজানো। আনোয়ার ছাদে হাঁটতে শুরু করে। নূপুরের শব্দ আরও স্পষ্ট শোনা যায়। মনে হচ্ছে একটু দূরে কেউ যেন হাঁটছে। আনোয়ার দ্বিধাহীনভাবে ওদিকে হেঁটে যায়। হ্যাঁ, ওদিকে আসলেই কেউ আছে।
‘কে, কে ওখানে?’ আনোয়ার বলে ওঠে।
ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটির হাঁটাহাঁটি বন্ধ হয়ে যায়। আনোয়ার মানুষটির আরও কাছে চলে আসে।
একটি মেয়ে। আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা। মুখে নেকাব।
‘কে আপনি?’ আনোয়ার প্রশ্ন করে বসে।
মেয়েটি আস্তে-আস্তে বলল, ‘আমি পরী।’
‘আপনার নাম পরী?’
‘না, আমি পরী। কোকাকে থাকি।’
‘মজা করছেন? আপনি চোর নাকি? এত রাতে এখানে? আপনার মতলব কী?’
‘এমনি ঘুরতে এলাম। আপনার সাথে গল্প করতে ইচ্ছা করছিল।’
ছাদের মৃদু আলোতে মেয়েটার হাতের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। নখগুলোতে নীল রঙের নেলপালিশ দেখতে পায় আনোয়ার।
মেয়েটা হাঁটতে-হাঁটতে ছাদের কিনারে চলে যায়। ওদিকে রেলিং নেই।
আনোয়ার শঙ্কিত মুখে বলল, ‘এই, কী করছেন? পড়ে যাবেন!’
মেয়েটার হাসির শব্দ শোনা গেল। আনোয়ারের মনে হলো কেয়া-খেয়া নয় তো! কিন্তু ও নিশ্চিত হতে পারছে না। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।
আনোয়ার বলল, ‘এই, আপনি কে বলুন তো?’
‘আমার নাম সুলেখা মিত্র।’
‘মিত্র? মানে আপনি তো হিন্দু! বোরকা পরেছেন কেন?’
‘কেন, কোনও হিন্দু কি বোরকা পরতে পারে না?’
উত্তর শুনে আনোয়ার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
মেয়েটি আবার বলল, ‘আসলে আমার সারা গায়ে রক্তের ছাপ, মাথার সামনের দিকটা থেঁতলে গেছে, মুখটাওঁ বেঁকে গেছে। এই জন্য নিজের চেহারা দেখাতে চাইছি না।’