আশপাশে তাকাল সুজানা। দেখতে পেল না জাফরকে। দ্রুত ফিসফিস করে বলে উঠল সুজানা, ‘জামিল ভাই, আমার খুব বিপদ। জাফরের উপরে ভর করেছে এক ভয়ঙ্কর প্রাণী। ও সবাইকে মেরে…’
কথা শেষ করতে পারল না সুজানা।
এসে পড়েছে জাফর। ওকে দেখে উঠে দাঁড়াল জামিল।
‘ভাল আছেন, জাফর ভাই? আমাকে চিনেছেন? আমি জামিল। আপনাদের বিয়ের দিনে পরিচয় হয়েছিল।’
জাফর নাক দিয়ে শব্দ করছে। খুব কাছে এসে শুঁকে দেখল জামিলকে। এর শরীরটা খুব বেশি পছন্দ হয়নি তার। তবু এটা দিয়েই এখন ভরাবে পেট। হঠাৎ জামিলের গলা চেপে ধরল জাফর।
ছটফট করতে শুরু করেছে জামিল। একটু অক্সিজেনের জন্য আঁকুপাঁকু করছে। দুই হাতে হামলা ঠেকাতে চাইল। কিন্তু ভাবলেশহীনভাবে জামিলের দিকে তাকিয়ে রইল জাফর। এতটুকু আলগা হলো না বজ্রমুষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গেল জামিল। দূরে চোখ বন্ধ করে সোফাতে বসে থাকল সুজানা। কিছু দেখতে চাইছে না। কিছুই না।
জামিলের চুল ধরে টেনে পাশের ঘরটায় নিয়ে গেল জাফর। এই ঘরেই মেরেছিল সে সুমি আর রিমিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে খণ্ড-বিখণ্ড করল জামিলের লাশটা। পুরো বুক, পেট লম্বালম্বিভাবে চিরে ফেলে খেতে শুরু করল। চোখ দুটো তুলে মুখে দিল প্রথমে। এরপর ঊরুর মাংস, পেটের ভিতরের চর্বি খেল। ঘরে রক্তের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।
বাইরে বেসিনে বিকট শব্দে বমি করতে থাকল সুজানা।
1
খাওয়ার মাঝপথে উঠে এল জাফর। সুজানাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিল তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আবার খাওয়া শুরু করল। খাওয়ার আনন্দে যেন অবশ হয়ে আসছে তার পুরো শরীর।
পাঁচ
ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে সুজানার। চোখ মেলে গতকালের মত আজও দেখতে পেল জাফরকে। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। জাফর তার দিকে তাকিয়ে ক্রূর হাসি হাসল। বলল, ‘তুমি কী খেতে চাও?’
‘কী?’
‘মানুষের রক্ত, মাংস, চোখ, চর্বি?’
‘না! না! না!’ শরীরের ভিতরটা গুলিয়ে উঠেছে সুজানার।
‘আমি তোমার জন্য রেখেছি। খাও। অনেক পুষ্টি। পুষ্টি প্রয়োজন তোমার সন্তানের।’ হেসে উঠল জাফর।
সুজানার সাথে মজা করছে সে।
সুজানা অবাক হয়ে লক্ষ করল, এই প্রথম তার মধ্যে তীব্র ভয়ের অনুভূতিটা কাজ করছে না। সে জাফরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমার সাথে মজা করবে না।’
কঠিন হয়ে গেল জাফরের চোখ-মুখ। সে বলল, ‘রাত হয়ে গেছে। আমার এখন পুষ্টিকর তরল, দুধ প্রয়োজন। দুধ নিয়ে এসো আমার জন্য।’
‘দুধ কি গরম করে আনব?’
‘আনো।’
জাফর ড্রয়িং রুমে গা এলিয়ে বসে আছে। রান্নাঘরে ঢুকে দুধ গরম করছে সুজানা। তার পুরো শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়। কারণ পঁচিশটা ঘুমের ওষুধ দিয়েছে সে দুধের মধ্যে। ওই ক’টা ওষুধই ছিল তার কাছে। রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ায় তাকে প্রতি রাতে একটা করে ওষুধ খেতে বলেছিল ডাক্তার। সেই ওষুধগুলোই কাজে লাগাতে চাইছে। কিন্তু তার পরিকল্পনা কি কাজে আসবে? জাফর কি ঘুমিয়ে পড়বে?
নিজেকে খুব স্বাভাবিক রেখে পাতিল ভর্তি দুধ জাফরের সামনে রাখল সুজানা। জাফর একটু অন্য দৃষ্টিতে তাকাল সুজানার দিকে। তারপর তাকাল পাতিলের দুধের দিকে। ধক ধক করছে সুজানার বুক। মনে হচ্ছে, বুকের ভিতরের শব্দটা বাইরে থেকে শোনা যাবে। কোনও কিছু কি আন্দাজ করছে জাফর? আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের হয়ে এল সুজানার। দুধ খাওয়া শুরু করেছে জাফর। সুজানা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সাত মিনিটের মধ্যে দেড় লিটার দুধ শেষ করল জাফর। বাকিটুকু আর খেতে চাইল না।
সুজানার দৃষ্টি এখনও জাফরের উপর নিবদ্ধ। দেখে মনে হচ্ছে পড়ছে না তার চোখের পলক।
হঠাৎ বলল জাফর, ‘ঝিমঝিম। ঝিমঝিম।’
সুজানা গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, ‘কী ঝিমঝিম?’ চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার গলায় উত্তেজনার ছাপ ফুটে উঠেছে।
‘মাথা ঝিমঝিম। খারাপ। খারাপ লাগে আমার।’ দশ মিনিট ধরে কেমন যেন এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াল জাফর। এরপর দড়াম করে পড়ে গেল মেঝেতে।
দ্রুত রান্নাঘর থেকে চাপাতিটা নিয়ে এল সুজানা। গত বছর কুরবানির ঈদে কিনেছিল ওটা।
জাফরের চোখ বন্ধ। কেমন যেন থেমে আছে নিঃশ্বাস।
দেরি করল না সুজানা। সবটুকু রাগ, সবটুকু ক্রোধ জাফরের শরীরে ঢালতে শুরু করল। প্রথমে চাপাতি দিয়ে কেটে দিল জাফরের গলাটা। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল সুজানার গা। জাফরের হাত ও পায়ের রগগুলো কেটে দিল। তারপর এলোপাথাড়ি কোপ দিতে শুরু করল শরীরে। সুজানার পুরো শরীরে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। ভয় নেই, আতঙ্ক নেই, আছে শুধু ক্রোধ।
ঠিক এই সময় চোখ খুলে গেল জাফরের। ঘুমের ওষুধের প্রভাব মাত্র পনেরো মিনিট কাজ করেছে ফ্যাফ্যাসের উপর। কিন্তু এই পনেরো মিনিটেই অনেক বড় সর্বনাশ করে দিয়েছে সুজানা ফ্যাফ্যাসের। রক্তে ভেসে যাচ্ছে জাফরের পুরো শরীর। ওঠার চেষ্টা করেও পড়ে গেল সে। ফ্যাফ্যাসের পোষক দেহটা মারা যাচ্ছে। তীব্র এক আর্তনাদ করে উঠল ফ্যাফ্যাস। সেই আর্তনাদের শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। জাফরের শরীর থেকে বেরিয়ে পড়ল ফ্যাফ্যাস। কিছুক্ষণ কাঁপতে থাকল জাফরের দেহটা, তারপর হয়ে গেল পুরোপুরি নিশ্চল। ফ্যাফ্যাস বুঝতে পেরেছে, তার আয়ু শেষের দিকে।
ফ্যাফ্যাসের আসল চেহারা দেখতে পেল সুজানা। ভয়ঙ্কর এই চেহারা দেখে যেন নড়ে উঠল সুজানার পেটের সন্তানও। সুজানার মনে হলো, তার সন্তান পেটের মধ্য থেকে বলছে, ‘মা, আমাকে বাঁচাও!’