নাদিয়া বলল, ‘আপনার চলে যাওয়াটা কি এতই জরুরি?’
আনোয়ার গায়ের চাদরটা ঠিকমত জড়িয়ে নিল। ‘হ্যাঁ। এখানে থাকতে আর ভাল লাগছে না।’
‘শুনেছেন নিশ্চয়, সুস্থ হয়ে গেছে রেহানা।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, কোনওভাবে রেহানাকে সুস্থ করেছেন আপনি।’
আনোয়ার হাসল। সেই হাসির অর্থ হ্যাঁ বা না-যে-কোনোটাই হতে পারে। নাদিয়া বলল, ‘আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব।’
আনোয়ার কিছু বলল না।
আনোয়ারের হাত ধরল নাদিয়া। ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিল আনোয়ার। রাগত স্বরে বলল, ‘কখনও আমার হাত ধরবে না তুমি।’ এরপর পিছনে না তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল ও।
পিছন থেকে এক দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখল নাদিয়া।
.
চাদর সরিয়ে ওর ডান হাতটা দেখল আনোয়ার। তালুতে বাসা বেঁধেছে কয়েকটা ছোট পোকা। একটা পোকার মুখে ডিমও দেখতে পেল আনোয়ার।
ওর শরীরে ভয়ঙ্কর পোকার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে খান্নাস!
হত্যা
এক
রুখসানাকে মেরে ফেলার পর দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তির পর যখন রুখসানার শরীরটা বিছানায় এলিয়ে পড়ল তখন ঘড়িতে রাত ৮টা বাজে। আর এখন ১০টা। দুই ঘণ্টা একটা লাশকে নিয়ে এক ঘরে থাকাটা বেশ কঠিন একটা বিষয়। তবে ইস্পাত কঠিন স্নায়ুর অধিকারী শওকতের জন্য বিষয়টা তেমন কঠিন নয়। খুনের মত এত বড় বিষয়ও তাকে উত্তেজিত করতে পারেনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট টানছে।
রুখসানাকে মেরে ফেলতে শওকতকে তেমন কোনও বেগ পেতে হয়নি। ঘুমের ওষুধ, ছুরি, পিস্তল-এ ধরনের কোনও উপকরণেরই প্রয়োজন পড়েনি। আজ অফিস থেকে ফিরেই রুখসানা খানিকটা সময় মাথা নিচু করে বসে ছিল। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছিল। শওকত বুঝতে পেরেছিল কোনও কিছু নিয়ে ঝামেলায় আছে।
রুখসানা বাইরের পোশাক বদলে কড়া গলায় বলে, ‘আমি কিছুক্ষণ ঘুমাব। আমাকে বিরক্ত করবে না।’
কথাটা শুনে খুশি হয় শওকত। বলে, ‘এক গ্লাস শরবত করে দিই? তারপর ঘুমাও।’
‘না। এখন কিছু খাব না। আমাকে প্লিজ বিরক্ত করবে না।’
মুখে একটা দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে শওকত বলে, ‘আচ্ছা। ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও।’ ঘুমাও কথাটার উপর অত্যাবশ্যক জোর দেয় সে।
রুখসানা ঘুমিয়ে পড়া মাত্রই শওকত আর দেরি করেনি। একটা বালিশ তার মুখের উপর চেপে ধরেছে। ‘বেচারি। বেশ কিছুক্ষণ বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমার শক্তির সাথে পেরে ওঠেনি,’ মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে নিজেকে বলল শওকত। নিজের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে তার।
শওকত অবাক হয়ে লক্ষ করল, মারা যাওয়ার পরেও রুখসানার শরীর অনেক গরম। সে শেষবারের মত গভীর মমতায় তার প্রিয় স্ত্রীকে আলিঙ্গন করল তার কপালে চুমু খেল। এরপর তাদের বড় ডিপ ফ্রিজটার মধ্যে রুখসানার লাশট ঢুকিয়ে দিল। অন্য আট-দশটা রাতের মত আজও সে শান্তিতে ঘুমাবে। যদি হঠা দেখে রুখসানা ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবু খুব বেশি বিচলিত হবে না। ধরে নেবে এসব হ্যালুসিনেশন। ভূতকে ভয় পেলে চলে না। রুখসানার লাশটা কাটাছেঁড়া করার বা কোনও জায়গায় ফেলে দেয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। লাশটা ফ্রিজেই থাকবে। আগামীকাল সকালেই বেনাপোল বর্ডার দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার ইচ্ছা তার। কারণ পালিয়ে থাকার জন্য ভারত বেশ উৎকৃষ্ট জায়গা।
প্রিয় বন্ধু আনিসকেও কিছুক্ষণ আগে মেরে ফেলেছে শওকত। তাকে অবশ্য রুখসানার মত সহজে মারতে পারেনি। রিভলভারের দুটো গুলি খরচ করতে হয়েছে। আজ ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনিসকে আশুলিয়া নিয়ে যায় শওকত। এরপর একটা জনশূন্য জায়গায় সুযোগ বুঝে…। সে খুব ভাল করেই টের পেয়েছিল আনিসের সঙ্গে রুখসানার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সম্পর্কের উষ্ণতা যে বাড়ছিল সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছিল। যে-কোনও সময় হয়তো রুখসানা তাকে ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এদিকে শওকত অনেক আগেই সব সম্পত্তি স্ত্রীর নামে লিখে দিয়েছে। তাই পাশার দানে হার এড়ানোর জন্য দু’জনকেই হত্যা করতে হলো।
বিছানায় শুয়েই শওকতের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। মনে হলো খাটের নীচে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। প্রথমে সে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মনের ভিতর তীব্র খচখচানি তাকে অস্থির করে ফেলল। অস্থিরতার কাছে পরাজিত হয়ে লাইট জ্বালল শওকত। এরপর খাটের নীচে উঁকি দিল। প্রচণ্ড চিৎকারে চারদিক যেন কেঁপে উঠল। খাটের নীচে আনিস শুয়ে আছে। আনিস শওকতের দিকে এক নজর তাকাল। তারপর নিজের মনে গাইতে লাগল, ‘Where have all the flowers gone?’
দুই
পুরানো দুঃস্বপ্নটা দেখে ঘুম ভাঙল শওকতের। তার হৃৎস্পন্দন হচ্ছে তড়িৎ গতিতে। সঙ্গে যোগ হলো নিঃশ্বাসে কষ্ট। মুখের ভিতরে শুকনো, খটখটে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই এক গ্লাস পানি পান না করলে সে মারা যাবে। শরীরটাও কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। নিজেকে মনে হচ্ছে প্যারালাইসিস রোগী। শওকত বাম হাতটা নাড়ানোর চেষ্টা করল। হ্যাঁ, বাম হাত নাড়াতে পারছে। কিন্তু বাম চোখে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না। তার পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে রুখসানা। ও ডাকার চেষ্টা করল, ‘রু-রুখ…’
রুখসানা ঘুমের ভিতরেই অস্ফুট স্বরে ‘উ’ বলল। সুন্দর মায়াবী একটা মুখ, রুখসানার। বিড়ালের মত আদুরে মুখমণ্ডল, ধনুকের মত শরীরের অবয়ব আর কমলার কোয়ার মত কোমল ঠোঁট। আর তার গাঢ় নিঃশ্বাসেও আছে কাছে আসার আহ্বান। স্বল্প পোশাকে তার শরীরের সৌন্দর্য যেন বহুগুণে বেড়ে গেছে। অনাবৃত পা শওকতের শরীরের উপর তুলে দিয়েছে রুখসানা। হালকা আকর্ষণীয় পা-টা শওকতের কাছে এখন ভয়ানক ভারী মনে হচ্ছে।