আসলে পুরো বিষয়টাই চলছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। খান্নাস বিশ্বাস করে ফেলেছে, ওর সামনে লোকমান ফকির বসে আছেন। তিনি বিভিন্ন সূরার আয়াত পড়ে ছুঁড়ে দিতেন লোহার শিক। তাতে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হত খান্নাসের। একইভাবে লোহার শিক ছুঁড়ে দিয়েছে আনোয়ারও।
এখন যদি ভয় পেতে থাকে আনোয়ার, বা এতটুকু ভুল করে, তবে সব শেষ করে দেবে খান্নাস।
বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করল খান্নাস। বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল শরীরের পোকাগুলো। বড় একটা আগুনের হলকা চলে গেল আনোয়ারের গা ঘেঁষে। আনোয়ারের শরীরে চেপে বসতে চাইল খান্নাস। অশরীরী কোনও শক্তিতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠল আনোয়ারের কপালের রগ। একইসাথে কেউ যেন জোরে- জোরে আঘাত করতে লাগল মাথায়। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল আনোয়ার। চোখের সামনে দেখতে পেল অনেকগুলো ভয়ঙ্কর মুখ, যেসব মুখ এ জগতের কারও নয়। এরপর দেখল কিছু মরা লাশ। কিছু হিংস্র জন্তু খাচ্ছে সেই লাশ, বারবার গর্জন করছে। তবু বিচলিত হলো না আনোয়ার। জানে, সব ভ্রম বা মিথ্যা। ওকে ভয় দেখাতে চাইছে খান্নাস। যদি একটু ভয়ও আনোয়ার পায়, তো ওকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে খান্নাস। কিন্তু ভয়ের অনুভূতিটা দূরে ছুঁড়ে ফেলল আনোয়ার। ও মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব। কিছুতেই হারবে না খান্নাসের কাছে।
আনোয়ার এবার দেখতে পেল পুরো ছাদে কিলবিল করছে অসংখ্য পোকা। গুটি-গুটি পায়ে সেগুলো এগিয়ে আসতে লাগল আনোয়ারের দিকে। কিছু-কিছু পোকার মুখে ডিমও দেখা গেল। চোখ বন্ধ করল আনোয়ার। এরপর দুটো ছোট মাটির ঢেলা নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করল দুই হাত। জোরে-জোরে লোকমান ফকিরের শিখিয়ে দেয়া কয়েকটি বিশেষ দোয়া পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পর হাতের মুষ্টি খুলল। ঢেলা দুটো ছুঁড়ে দিল খান্নাসের দিকে।
আক্রোশে দাপাতে লাগল খান্নাস। এক নিমেষে যেন কাঁপিয়ে দিল সে পুরো ছাদটা। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ফুলের টবগুলো। এরপর রাগত গলায় বলল, ‘হুজুর, আমি রেহানাকে ছেড়ে চলে যাব। আমি আর মানব সমাজে আসব না।’
‘কথা দিচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি।’
‘আমি আবার চোখ বন্ধ করছি। চোখ খুলে যেন দেখি তুই নেই।’
‘জী, হুজুর। আমি চলে যাচ্ছি। তবে আপনার জন্য কিছু একটা রেখে যাব আমি। অবশ্যই রেখে যাব।’
চোখ বন্ধ করে আছে আনোয়ার। প্রচণ্ড বাতাসে ঠিক রাখতে পারছে না সে নিজেকে। নাড়ি-ভুঁড়ি বের হওয়া মরা বিড়ালটা নড়ে উঠল হঠাৎ। জোরে ডেকে উঠল, ‘মিয়াও!’
বিদ্যুতের ঝলকে যেন আলোকিত হয়ে গেল পুরো আকাশটা। বেশ কিছুক্ষণ পর শান্ত হলো ছাদের পরিবেশ।
আনোয়ার চোখ মেলে দেখল, ওকে ঘিরে আছে অসংখ্য পোকা। সবগুলো যেন ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল একসাথে।
শরীর থেকে পোকাগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল আনোয়ার। কিন্তু ওর শরীর আঁকড়ে ধরে রাখল ওগুলো।
নয়
জ্ঞান নেই রেহানার। মুখ দিয়ে ক্রমাগত বেরোচ্ছে ফেনা। বারবার অনিয়ন্ত্রিতভাবে কেঁপেও উঠছে। কিছু যেন কিলবিল করে ছুটে বেড়াচ্ছে ওর শরীরের মধ্য দিয়ে রেহানাকে শক্ত করে ধরে আছে সেজান। ভয়ার্ত চোখে রেহানার দিকে তাকিয়ে আছেন মামী। রেহানার মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। আজ খুব খারাপ কিছু ঘটবে মনে হচ্ছে সেজানের। চোখের পানি মুছল সে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার।
এভাবেই বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলো।
সেজানের সব আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে হঠাৎ তাকাল রেহানা। সেজানের দিকে চেয়ে বলল, ‘পানি খাব।’
সেজান বিস্মিত হলো। দ্রুত এনে দিল পানি। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘তোমার এখন কেমন লাগছে?’
‘খুব ভাল লাগছে। কেন জানি মনে হচ্ছে, সুস্থ হয়ে গেছি। পুরো সুস্থ হয়ে গেছি। আচ্ছা, কয়টা বাজে? …তোমার নিশ্চয়ই রাতে খাওয়া হয়নি। ফ্রিজে মাংস আছে। রুটি বানিয়ে দিচ্ছি আমি। আমারও এত খিদে লেগেছে যে, মনে হচ্ছে পঞ্চাশটা রুটি খেতে পারব।’
সেজান বলল, ‘তোমাকে কিছু করতে হবে না। তোমার শরীর অসুস্থ। তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো। কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব তোমাকে।’
হাসিমুখে রেহানা বলল, ‘আমাকে আর ডাক্তার দেখাতে হবে না। আমি সুস্থ হয়ে গেছি।’ আসলেই একদম অন্যরকম লাগছে রেহানার। এতদিন যে ভয়টা বুকে পুষে রেখেছিল, এই মুহূর্তে সেই ভয়টা যেন মুছে গেছে। কেন জানি মনে হচ্ছে, সে আর কোনও দিন দেখবে না সেই ভয়ঙ্কর লোকটাকে।
সেজানের মুখে হাত বুলিয়ে দিল রেহানা। বলল, ‘আমি তোমাকে আমার জীবনের কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার আর প্রয়োজন নেই।’
‘প্রয়োজন না থাকলেও বলো।’
‘না। ওই কষ্টের কথাগুলো আমি আর মনে করতে চাই না।’
‘আচ্ছা, তা হলে থাক। বাদ দাও। কষ্টের কথা ভুলে যাওয়াই ভাল। তবে আমি একটা কথা বলতে চাই তোমাকে।’
‘কী তা?’
‘আমি সব বিপদে তোমার পাশে থাকব। কাপুরুষের মত পালিয়ে যাব না।’
মামী আরেক ঘরে যেতেই রেহানার খুব ইচ্ছা হলো সেজানকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু লজ্জা-লজ্জা লাগছে। শেষ পর্যন্ত ভালবাসার কাছে লজ্জার পরাজয় ঘটল।
নতুন জীবন শুরু হলো রেহানা ও সেজানের
দশ
আজ নিজের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে আনোয়ার। আবার খারাপ করেছে ওর শরীরটা। সবসময় লেগে থাকছে মাথাব্যথা ও বমি-বমি ভাবটা। খাওয়ার রুচি নেই একদম।