“পড়ে কী হবে?”
শামীম চোখ কপালে তুলে বলল, “বলিস কী তুই? পড়ে কী হবে মানে? না পড়ে তুই কী করবি?”
“তুমি আর আমি ঘুরে বেড়াব। পৃথিবীর যত নদী আছে দেখব। যত লোক আছে দেখব। যত সমুদ্র আছে দেখব।”
শামীম হেসে সেরিনার মাথার ভেজা চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। তুই আর আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব। কিন্তু সে জন্যে পড়া বন্ধ করতে হবে কে বলেছে?”
সেরিনা কিছু বলল না কিন্তু শামীমের যুক্তিটা মেনে নিল সেরকম মনে হল না। বিকেলে সেরিনা বলল, “আব্বু, আমি আবার পানিতে নামি?”
শামীম জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না। তোর আলেক্স চাচা আমাকে অনেকবার বলেছে আমি যেন তোকে সবসময় পানিতে ফেলে না রাখি।”
“কেন?”
“তাহলে ধীরে ধীরে তুই তোর ফুসফুস ব্যবহার করতে ভুলে যাবি। চামড়ার নিচে তোর রক্তনালীগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।”
“আলেক্স চাচা আর কী বলেছে?”
“বলেছে তুই যখন বড় হবি তখন খুব হ্যাঁন্ডসাম একটা ছেলের সাথে তোকে বিয়ে দিতে।”
“যাও।” বলে সেরিনা শামীমকে একটা ধাক্কা দিল। “আলেক্স চাচা এটা বলতেই পারে না। আমি কোনোদিন বিয়ে করব না।”
“ঠিক আছে করিস না।”
“আমি তোমার সাথে থাকব।“
“ঠিক আছে থাকিস।”
সেরিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার খুব আলেক্স চাচাকে দেখার ইচ্ছা করে।”
সেরিনা শামীমের কাছ থেকে অনেকবার আলেক্সের গল্প শুনেছে। সেরিনার কথা শুনে মানুষটি সেই আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি থেকে রাতারাতি এই দেশে হাজির হয়েছিল। বাক্স বোঝাই করে ওষুধপত্র যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিল। আলেক্স যদি তখন তাকে চিকিৎসা না করতে তাহলে সে নাকী অন্যরকম হয়ে বড় হতো। অক্সিজেনের অভাবে তার মস্তিষ্ক ঠিকভাবে তৈরি হতো না, সে নাকী অনেকটা মানসিক প্রতিবন্ধীর মতো হয়ে যেতো। যে মানুষটা তাকে ঠিক ঠিক মানুষ কিংবা মৎস্যকন্যা করে দিয়েছে তার জন্যে সেরিনা সবসময়েই এক ধরণের ভালোবাসা অনুভব করে। মাউন্ট রেইনিয়ারে বরফের ধ্বসে আলেক্স সারা জীবনের জন্যে হারিয়ে গেছে সেরিনা সেটা মানতেই পারে না!
সেরিনা শামীমের হাত ধরে বলল, “আচ্ছা আব্বু, এ-রকম কী হতে পারে যে আলেক্স চাচা আসলে তুষার ধ্বসে মারা যায় নাই?”
সেরিনা কী বলতে চাইছে শামীম সেটা অনুমান করার চেষ্টা করে বলল, “হতে তো পারেই। কিন্তু তাই যদি হতো তাহলে এতোদিনে কী একবার তোকে দেখতে আসতো না?”
“এরকম কী হতে পারে না যে আলেক্স চাচা বরফ ধ্বসে মারা যায় নাই কিন্তু বরফের নিচে চাপা পড়েছে বলে তার কিছু মনে নাই!”
শামীম অনিশ্চিতের মতো বলল, “হতে পারে।”
“তাহলে এমন কী হতে পারে না যে একদিন হঠাৎ করে আলেক্স চাচার সবকিছু মনে পড়ে যাবে তখন আলেক্স চাচা আমাকে দেখার জন্যে ছুটে আসবে?”
শামীম এই ছেলেমানুষ মেয়েটির দিকে এক ধরনের মমতা নিয়ে তাকাল, তারপর নরম গলায় বলল, “হ্যাঁ। হতেই তো পারে।”
সেরিনার সারা মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, বলল, “তখন কী মজা হবে, তাই না আব্বু?”
“হ্যাঁ। তখন অনেক মজা হবে।”
“আমি তখন আলেক্স চাচাকে নিয়ে স্কুলে যাব।”
“ঠিক আছে।” শামীম সেরিনার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, “চল এখন আমরা হেঁটে আসি। মাঠে সব বাচ্চারা আছে তাদের সাথে খেলবি চল।”
“চল আব্বু।”
.
একটু পরে দেখা গেল ধান কাটার পর খালি হয়ে যাওয়া মাঠটাতে গ্রামের ছোট বড় অনেক ছেলে মেয়ের সাথে সেরিনা খেলছে। শামীম খেতের আলে বসে থেকে সেরিনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। হরিণীর মতো ক্ষীপ্র একটি মেয়ে। পানির নিচে সে কী করে শামীম কখনো দেখে নি কিন্তু মাটির ওপরে সেরিনার মতো ক্ষীপ্র একটি মেয়ে সে কখনো দেখে নি। পৃথিবীর কেউ জানে না এই মেয়েটি কী বিস্ময়কর। যদি কখনো তারা জানতে পারে তখন কী হবে চিন্তা করেই শামীমের বুক কেঁপে ওঠে।
.
রাতে খাওয়ার পর টেবিলের দুই পাশে শামীম আর সেরিনা বসে পড়াশোনা করছে। শামীম একটা মেডিক্যাল জার্নাল পড়ছে সেরিনা একটা জটিল এলজেবরা সমাধান করার চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত এলজেবরাটাকে ঘায়েল করে সেরিনা একটা আনন্দের ধ্বনি করল। শামীম চশমার ওপর দিয়ে সেরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে? এতো আনন্দ কিসের?”
“একটা এলজেবরা করেছি।”
“গুড।”
“অনেক কঠিন ছিল।”
“ভেরি গুড।”
“এলজেবরা করে আমার মগজ জ্যাম হয়ে গেছে।”
“এখন এই জ্যাম ছোটানোর জন্যে কী করতে হবে?”
“আমার সাথে গল্প করতে হবে।”
“কীসের গল্প?”
সেরিনা লাজুক মুখে বলল, “আমার আম্মু আর আব্বুর গল্প। তুমি কেমন করে আমাকে পেয়েছ সেই গল্প।”
শামীম মনে মনে একটা নিশ্বাস ফেলল। সেরিনাকে সে কীভাবে পেয়েছে সেই সত্যি ঘটনাটি সে কখনো তাকে বলে নি। তাকে খুঁজে পাওয়ার একটা কাল্পনিক গল্প বলেছে, সেই গল্পটি সেরিনার খুব প্রিয়। মাঝে মাঝেই সেই গল্পটি তাকে বলতে হয়। গল্পটি এতোবার বলেছে যে এখন তার নিজের কাছেই এটাকে সত্যি বলে মনে হয়।
শামীম হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তোকে কতোবার এই গল্প বলেছি–আর কতোবার শুনবি?”
সেরিনা বলল, “আরো অনেকবার শুনব আব্বু। গল্পটা শুনতে আমার একটু কষ্ট হয় আবার একটু ভালো লাগে।”
শামীম বলল, “ঠিক আছে, তাহলে কাছে আয়। আমার কাছে বস।”
সেরিনা শামীমের কাছে এসে তার গলা ধরে বসল। শামীম তখন সেরিনাকে খুঁজে পাওয়ার সেই কাল্পনিক কাহিনীটা শুরু করে। কীভাবে একটা নদী দিয়ে সে স্পিড বোটে করে যাচ্ছে, বিশাল নদী সেখানে উথাল পাতাল ঢেউ। সেই নদীতে নৌকা করে একজন মাঝি তার স্ত্রীকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। মাঝ নদীতে হঠাৎ ঝড় উঠেছে। সেই ভয়ংকর ঝড়ের মাঝে কীভাবে মাঝি তার নৌকাটাকে উথাল পাথাল ঢেউয়ের মাঝে হাল ধরে রেখেছে। ঠিক তখন স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠেছে। ডাক্তার নেই, দাই নেই, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই তার মাঝে সন্তানের জন্ম হল, ফুটফুটে একটা মেয়ে। ঠিক তখন নৌকা পড়েছে এক ঘূর্ণির মাঝে, সাথে দমকা হাওয়া, হঠাৎ করে নৌকা কাত হয়ে গেল। সন্তান ছিটকে পড়ল নদীতে তাকে বাঁচানো জন্যে মা ঝাঁপ দিল নদীতে আর মাঝিও তখন স্ত্রী আর সন্তানকে বাঁচানোর জন্যে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ঘূর্ণিতে টেনে নিচ্ছে স্ত্রী আর সন্তানকে, মাঝি প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাদের বাঁচানোর জন্যে।