হঠাৎ পুকুরের ঠিক মাঝখানে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সেরিনা লাফিয়ে উঠে, তার সমস্ত শরীর পানি থেকে বের হয়ে আসে, দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে সে চরকীর মতো ঘুরপাক খেতে খেতে আবার পানিতে আছড়ে পড়ে, তারপর সে পানি ছিটিয়ে সাঁতরে সাঁতরে পুকুর ঘাটের দিকে আসতে থাকে। পুকুরের সিঁড়ি ধরে সে শামীমের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, “আব্বু! তুমি ভয় পেয়েছ?”
শামীম বলল, “তোর ধারণা, আমি তোকে ভয় পাই?”
“চমকে উঠেছ কী না বল?”
“হ্যাঁ একটু চমকে উঠেছি। হঠাৎ করে পানি থেকে লাফ দিলি তো, সেজন্যে।”
সেরিনা পুকুর ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে, শামীমের বড় একটা টি শার্ট পরেছে, সেটা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। মাথার ভিজে চুলগুলো তার মুখে লেপটে আছে। ভিজে শরীর থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সেরিনা ওপরে উঠে ভিজে শরীরে শামীমকে জাপটে ধরে আহ্লাদী গলায় বলল, “আবু আব্বু আবু আব্বু! আমার সুইট আব্বু।”
শামীম বলল, “দিলি আমাকে ভিজিয়ে!”
“ভিজলে কিছু হয় না আব্বু, আবার শুকিয়ে যায়।” শামীম হাত দিয়ে সেরিনাকে ধরে বলল, “তোর কিছু হয় না। তুই হচ্ছিস মৎস্যকন্যা। আমরা তো তোর মতো মৎস্যকন্যা না। মৎস্যমানবও না। আমরা হচ্ছি বোরিং মানুষ”
“মৎস্যমানব হওয়া খুব সোজা। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।”
শামীম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “থাক। আমাকে আর কিছু শিখাতে হবে না।”
সেরিনা বলল, “আব্বু! যা খিদে পেয়েছে তোমাকে কী বলব। মনে হচ্ছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।”
“থাক। আস্ত ঘোড়া খেতে হবে না। ভাত খাবি আয়।”
সেরিনা তার ভিজে শরীরে শামীমকে ধরে রাখে। সেই অবস্থায় দুইজনে পুকুর ঘাট থেকে গাছ গাছালীর ছায়া দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ঢুকল। বাসায় কেউ নেই, সাধারণত কেউ থাকে না। সকালে একজন মহিলা এসে ঘর দোর পরিষ্কার করে দেয়। বিকেলে এসে একটু রান্না করে দেয়।
সেরিনা তার ভেজা শরীর মোছায় কোনো চেষ্টা করল না। যতক্ষণ পানিতে ছিল একবারও সে নিশ্বাস নেয় নি। পানি থেকে উপরে উঠে ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে শুরু করেছে। শরীর পুরোপুরি শুকিয়ে যাবার পর সে আবার সত্যিকার অর্থে নিশ্বাস নেবে ফুসফুস ব্যবহার করে বাতাস থেকে অক্সিজেন নেবে। যখন ছোট ছিল তখন সেরিনাকে এটা শেখাতে হয়েছে। আস্তে আস্তে এটা সেরিনার জন্যে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে তাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়, যখন অন্যদের সামনে থাকে তখন তাকে ভেজা থাকলেও নিশ্বাস নেবার একটা সুক্ষ্ম অভিনয় করতে হয়।
শামীম খাবার গরম করে টেবিলে রাখতে থাকে। সেরিনা ভেজা শরীরে ঘুর ঘুর করে শামীমকে সাহায্য করে, তারপর দুজন খেতে বসে। সেরিনার প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার সাথে সাথে সে খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। শামীম কিছুক্ষণ তাকে খেতে দেখল তারপর বলল, “তোর এত হুড়মুড় করে খেতে হবে না। আস্তে আস্তে খা। তোর খাবার কেউ চুরি করে নেবে না!”
সেরিনা আবার হি হি করে হাসল, বলল, “তোমাকে বলেছি না খিদে লেগেছে!”
“এক ঘণ্টা পানির নিচে সাতরাবি, খিদে লাগবে না!”
“আমি পানির নিচে সাঁতরাই না আব্বু।”
“কী করিস?”
“ঘুরে বেড়াই। শুয়ে থাকি। মাছদের সাথে কথা বলি।”
শামীম হেসে ফেলল, “কী কথা বলিস? কেমন আছেন, ভালো আছেন? ডিম পাড়বেন?”
সেরিনা আবার হি হি করে হাসল, বলল, “আগে মাছগুলো আমাকে দেখলে পালিয়ে যেত। এখন পালায় না। কাছে আসে। আমার সাথে সতরায়। আমি মাঝে মাঝে সাঁতারের কম্পিটিশন করি।”
“কে জেতে?”
“মাছ!” সেরিনা এক টুকরো সবজি চিবুতে চিবুতে বলল, “একটা জিনিস জান আব্বু?”
“কী জিনিস?”
“মাছগুলো কিন্তু বোকা! কুকুর বেড়াল যেরকম পোষ মানে সাথে সাথে ঘুরে বেড়ায মাছগুলো মোটেও সেরকম না। এরা পোষ মানে না।”
শামীম বলল, “তাই তো হবার কথা! কুকুর বেড়াল হচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণী। ম্যামেল। তাদের বুদ্ধি তো বেশি হবেই।”
“মাছদের মাঝে স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই?”
“থাকবে না কেন? তিমি মাছ? তিমি মাছ তো আসলে মাছ না। তিমি মাছ হচ্ছে ম্যামেল। স্তন্যপায়ী প্রাণী।
সেরিনা হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে বলল “আমরা তো পুকুরে তিমি মাছ পালতে পারব না! এক তিমি মাছেই পুরো পুকুর ভরে যাবে!”
শামীম বলল, “ডলফিনও ম্যামেল। ডলফিন সাইজে ছোট আছে।”
সেরিনা আদুরে গলায় বলল, “আব্বু আমাকে একটা ডলফিন এনে দেবে? প্লীজ প্লীজ!”
“কি করবি?”
“পালব। সাথে নিয়ে সাঁতরাব।”
“এনে দিতাম কিন্তু সমস্যা আছে”
“কী সমস্যা?”
“এগুলো তো লোনা পানিতে থাকে, তোর পুকুরে মনে হয় না বেঁচে থাকতে পারবে।”
সেরিনা আশা ভঙ্গের মতো একটা শব্দ করল। শামীম বলল, “তোর সমস্যাটা কী? পানির নিচেই সবকিছু করতে হবে? পানির উপর কুকুর বিড়াল গরু ছাগল কতো কী আছে? তাদের পোষ মানিয়ে তাদের সাথে সময় কাটা।”
“সেটা তো সবসময়েই কাটাই।”
“শুধু কুকুর বিড়াল কেন? তোর স্কুল আছে না? স্কুলের বন্ধু বান্ধব আছে না? টিচার আছে না?”
সেরিনা বলল, “বন্ধু বান্ধব ঠিক আছে, কিন্তু টিচাররাই তো সমস্যা।”
শামীম জিজ্ঞেস করল, “কেন? টিচাররা কী সমস্যা করল?”
“খুবই কড়া। খালি বলে পড় পড়।“
“বলবেই তো। টিচাররা যদি পড়ার কথা না বলে তাহলে কী বলবে? বলবে খাও খাও? ঘুমাও ঘুমাও?”
সেরিনা মাথা নাড়ল, বলল, “আমার পড়তে ভালো লাগে না।” কারো পড়তে ভালো লাগে না। তবু পড়তে হয়।”