শামীম সার্টটা খুলতে খুলতে বলল, “বুঝলি রিতু, আজকে ছোট একটা বাচ্চাকে হাসপাতালে রেখে এসেছি। বাচ্চাটা মনে হয় বাঁচবে না।”
শামীম মাঝে মাঝেই এ-রকম করে, জোরে জোরে কথা বলে যেন সত্যিই রিতু কিংবা শাহানা তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। কেউ তাকে এটা করতে দেখে নি, দেখলে নিশ্চিত ভাবেই ধরে নিতো সে একজন বদ্ধ উন্মাদ।
একটু পরে শামীম আবার বলল, “নিমোনিয়া হয়ে গেছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না। অক্সিজেন দিতে হবে, তারপরেও লাভ হবে মনে হয়।” বাথরুমে হাত মুখ ধুতে ধুতে বলল, বাচ্চাটা যদি বেঁচে যেতো সেটা একটা অসাধারণ গল্প হতো। কিন্তু মুশকিল কী জানিস?” শামীম একটু থেমে বলল, “মুশকিল হল রিয়েল লাইফে অসাধারণ গল্প নাই। ম্যাজিক নাই। রিয়েল লাইফ খুবই কঠিন। খুবই বোরিং।”
শামীম ফ্রীজ থেকে কিছু খাবার বের করে মাইক্রো ওয়েভ ওভেনে গরম করে খেতে খেতে আবিষ্কার করল তার ভেতরে আবার কোনো একটা কিছু নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি। শুধু মনে হচ্ছে কিছু একটা জিনিস হিসেব মিলছে না, কোথায় সেই হিসাব মিলছে না সে ধরতে পারছে না।
খাওয়া শেষ করে শামীম যখন এক কাপ চা তৈরি করে সোফায় হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে কাপে চুমুক দিচ্ছে তখন সে হঠাৎ করে চমকে উঠল। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল কেন হিসেবটি মিলছে না, হঠাৎ করে সেটা সে বুঝতে পেরেছে কেন তার ভেতরে এতো অস্বস্তি।
গ্রামের সেই ডোবাতে কিশোরী মেয়েটা যখন প্রথমবার এই শিশুটাকে একটা বড় মাছ মনে করে তার বাবাকে ডাকতে গেল তখন থেকে সে ডোবার পাশে বসে ডোবার পানির দিকে তাকিয়েছিল। সে বাচ্চাটিকে দেখে নি-তার কারণ বাচ্চাটা পানিতে ডুবেছিল। একজন মানুষ নিশ্বাস না নিয়ে পানির ভেতরে বড় জোর এক দুই মিনিট থাকতে পারে। কিন্তু এই বাচ্চাটা তার চোখের সামনেই কম পক্ষে টানা পনেরো মিনিট পানিতে ডুবেছিল-এই পনেরো মিনিটি বাচ্চাটা একবারও নিশ্বাস নেয় নি। এটি কীভাবে সম্ভব? সে যখন বাচ্চাটিকে পানি থেকে তুলেছে তখন বাচ্চাটির পুরোপুরি জ্ঞান আছে, বাচ্চাটি তার দিকে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিল। নবজাতকের বিস্ময়কর সেই বুক কাঁপানো দৃষ্টি।
শামীম তার চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেল। তার সামনেই কম পক্ষে পনেরো মিনিট পানিতে ডুবেছিল, সে এখানে হাজির হওয়ার আগে কতোক্ষণ ডুবেছিল কে জানে। তাকে নিশ্চয়ই দিনের আলোতে ডোবায় ফেলে নি, রাতের অন্ধকারে ফেলেছে। যার অর্থ এই শিশুটি নিশ্চয়ই বেশ কয়েক ঘণ্টা পানিতে ডুবে আছে। কিন্তু পানিতে ডুবেও বাচ্চাটি মারা যায় নি। সেটি একটি অসম্ভব ব্যাপার–মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে নিশ্বাস নিতে হয়, শরীরের কোষে কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দিতে হয়। শরীরের সমস্ত জৈবিক কাজ সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিতে পারলে হয়তো নিশ্বাস নেবার প্রয়োজন হবে না, কিন্তু বাচ্চাটির জৈবিক কাজ তো বন্ধ হয় নি! বাচ্চাটির তো পুরোপুরি জ্ঞান ছিল, মাঝে মাঝে পানিতে খল-বল করে মাছের মতো নড়ে উঠেছিল। বাচ্চাটিকে তোলার পর তার হাতের ভেতর নাড়াচাড়া করেছে, সে পুরোপুরি সতেজ একটা শিশুর মতো ছিল। কোনো নিশ্বাস না নিয়ে-এটি কীভাবে সম্ভব?
শামীম একটু অবাক হল, বিষয়টা কেন তার চোখে এতোক্ষণ পর ধরা পড়ল? যেহেতু এটা অসম্ভব একটি ঘটনা তাই নিজের অজান্তেই সে ধরে নিয়েছে নিশ্চয়ই এটি সত্য নয়, নিশ্চয়ই অন্য কিছু ঘটেছে যেটা তার চোখে পড়ে নি। তা ছাড়া বাচ্চাটাকে প্রাণে বাঁচানোটাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য তখন অন্য কোনোকিছু সাময়িক ভাবে তার মাথায় আসে নি।
শামীম চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল। সে হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চাটিকে আরো একবার দেখে আসবে। এই রহস্যময় শিশুটিকে আরো একবার নিজের চোখে দেখে আসা দরকার।
শামীম যখন হাসপাতালে পৌঁছেছে তখন সেখানে অনেক ভীড়। সরকারী হাসপাতালে যে-রকম হয়, রোগীর তুলনায় নার্স ডাক্তারের সংখ্যা খুব কম। হাসপাতালের কোনো নিয়ম কানুন নেই, লোকজন ইচ্ছে মতো ভেতরে ঢুকছে, বের হচ্ছে, রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাদের ওয়ার্ডে সব বাচ্চার কাছেই তার মা কিংবা কোনো আত্মীয় স্বজন দাঁড়িয়ে আছে। শামীম যে শিশুটিকে হাসপাতালে রেখে গেছে তার কাছে কেউ নেই, নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো ছিল সেটা সরে গেছে কেউ লক্ষ্য করে নি। বুকটা খুব দ্রুত ওঠা নামা করছে, ঠোঁটগুলো নীল। শামীম বুঝতে পারলো বাচ্চাটি এর মাঝে মৃত্যুর দিকে আরো কয়েক পা এগিয়ে গেছে।
শামীম এদিক সেদিক তাকিয়ে একজন নার্স খুঁজে বের করল, জিজ্ঞেস করল, “এই বাচ্চাটার কী খবর?”
নার্স একটা স্যালাইনের ব্যাগ নিয়ে একদিকে প্রায় ছুটে যাচ্ছিল, বলল, “ডিউটি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন।”
শামীম ডিউটি ডাক্তারকে খুঁজে বের করার জন্য এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল তখন পিছন থেকে কেউ একজন ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী সমস্যা?”
শামীম ঘুরে তাকাল, ধড়ের ওপর মাথা বসানো গাট্টাগোট্টা একজন মানুষ। গায়ে ডাক্তারের এপ্রন, গলা থেকে স্টেথিস্কোপ ঝুলছে তাই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা ডাক্তার। শামীম হাসি হাসি মুখ করে বলল, “না, কোনো সমস্যা নেই। আমি এই বাচ্চাটাকে ভর্তি করে গিয়েছিলাম, দেখতে এসেছি কেমন আছে।”