সেরিনা পানি থেকে মাথা বের করে কামানটাকে আরো ভালো করে দেখার চেষ্টা করল, নিচ থেকে ঠিক করে দেখা যাচ্ছিল না তাই সে রাত গম্ভীর হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
এক সময় তিমি শিকারীদের হল্লা থেমে গেল, সেরিনা বুঝতে পারল সবাই নিশ্চয়ই এখন ঘুমিয়ে গেছে। সে তখন খুব সাবধানে জাহাজের গলুই বেয়ে উপরে উঠে আসে। সাবধানে রেলিং টপকে জাহাজের পাটাতনে নেমে এল, তারপর কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে অপেক্ষা করল। যখন দেখল কেউ নেই তখন সে পা টিপে টিপে হারপুন ছোঁড়ার কামানটার কাছে এগিয়ে যায়।
বড় বড় স্কু দিয়ে কামানটা পাটাতনের সাথে লাগানো আছে, ভিতর থেকে কয়েক ফুট উপরে উঠে এসেছে, সেখানে একটা ধাতব সিলিন্ডার হারপুনটা এর ভেতরে ঢোকানো থাকে। হরপুনের সাথে দড়ি লাগানো। দড়িটা কামানের পিছনে সাবধানে বৃত্তাকারে পেঁচিয়ে রাখা আছে। হারপুনটা যখন ছুটে যায় তখন এই দড়িগুলো পাক খুলতে খুলতে যেতে থাকে।
পুরো কামানটা উপড়ে নেয়া হয়তো সম্ভব হবে না। নাইলনের দড়ি যত শক্তই হোক এক সময় ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু হারপুন ছোঁড়ার ব্যারেলটা মনে হয় বাঁকা করে দেয়া যেতে পারে। তাহলেই এটা অচল হয়ে যাবে। সেরিনা তখন সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে গেল। হারপুনের দড়ি দিয়েই হারপুন ছোঁড়ার ব্যারেলটা ভালো করে বেঁধে দিল। বাড়তি দড়ি দিয়ে সে কামানটাকেও বেঁধে ফেলল শুধু একটা দড়ি ছিঁড়ে যেতে পারে বলে সে কয়েক প্রস্থ দড়ি ব্যবহার করে, তারপর দড়ির মাথাগুলো পানিতে ফেলে দিল। তার আপাতত কাজ শেষ, এখন একটা তিমি মাছকে রাজী করাতে হবে এই দড়িটা ধরে টেনে নিতে! তিমি মাছেরা আনন্দের সাথে রাজী হবে কিন্তু বিষয়টা বোঝানোই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
জাহাজের গলুই থেকে নেমে যাবার আগে সে জাহাজটা একটু ঘুরে দেখতে গিয়ে রাইফেলগুলো আবিষ্কার করলো। একটা স্ট্যান্ডের মাঝে সুন্দর সাজানো আছে। সেরিনা রাইফেলগুলো নিয়ে একটা একটা করে সবগুলো সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিল। তারপর জাহাজ থেকে নেমে পানিতে ডুবে গেল।
পানিতে নেমে সে একটা তিমি মাছ খুঁজতে থাকে। তিমি মাছগুলো এই পথ দিয়ে যায়, সেজন্যেই তিমি শিকারীগুলো এখানে আস্তানা গেড়েছে তাই কিছুক্ষণেই সে একটা তিমি মাছের দলকে পেয়ে গেল। পানির নিচ অন্ধকার, তার মাঝেই বিশাল একটা তিমি মাছ তাকে দেখে চিনতে পেরে তার কাছে এগিয়ে আসে, তাকে মুখ দিয়ে স্পর্শ করে, ফ্লিপার দিয়ে তার শরীর বুলিয়ে দেয়। সেরিনা তখন তিমি মাছটার একটা ফ্লিপার ধরে তাকে টানতে থাকে, প্রথমে তিমি মাছটা ঠিক বুঝতে পারছিল না সেরিনা কী চাইছে, একটু পরে মনে হলো বুঝতে পারল, তখন সেরিনার সাথে সাথে সেটি জাহাজটার কাছে যেতে থাকে। জাহাজের কাছে যাবার পর সেরিনা হারপুনের দড়িটা তিমি মাছটার মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে দিয়ে আবার তার ফ্লিপারটা ধরে টানতে থাকে।
তিমি মাছটা বুঝতে পারল তাকে এই দড়িটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিতে হবে এবং সে সত্যি সত্যি হ্যাঁচকা টান দিল, দড়ির টানে হারপুন ঘোড়ার পুরো কামানটি উপড়ে এসে জাহাজের রেলিংয়ে আটকে গেল। দ্বিতীয়বার হ্যাঁচকা টান দিতেই কামানটির ধাতব সিলিন্ডারটা প্রচণ্ড চাপে বাঁকা হয়ে যায়, সাথে সাথে ভেতরে রাখা বিস্ফোরকটা শব্দ করে বিস্ফোরিত হয়ে গেল।
সেরিনা তখন দড়িটা তিমি মাছের মাথা থেকে খুলে নেয়, তারপর তিমি মাছের বিশাল দেহটাকে একবার আলিঙ্গন করে তাকে বিদায় দিয়ে দেয়। তিমি মাছটা জাহাজের চারপাশে একবার পাক খেয়ে তার গন্তব্যের দিতে যেতে থাকে।
সেরিনা জাহাজের কাছে এসে উপরে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করল। বিস্ফোরণের শব্দে জাহাজের অনেকের ঘুম ভেঙ্গে গেছে, তারা জাহাজের গলুইয়ে ছুটে এসেছে, হারপুন ছোঁড়ার পুরো কামানটা উপড়ে গিয়ে জাহাজের রেলিংয়ে পড়ে থাকতে দেখে মানুষগুলো হতবুদ্ধি হয়ে গেল, এরকম একটা ব্যাপার কেমন করে ঘটতে পারে তারা কোনোভাবে তার ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না।
পরদিন জাহাজটা এই এলাকা ছেড়ে চলে গেল।
১৫-১৭. আকাশের দিকে মুখ করে
১৫.
আকাশের দিকে মুখ করে সমুদ্রের পানিতে শুয়ে আছে সেরিনা। রাতের আকাশে নক্ষত্রগুলো স্ফটিকের মতো জ্বল জ্বল করছে। পূর্ব আকাশে কালপুরুষ নক্ষত্রমালা উঠেছে। শামীম বলেছিল যখন সূর্য ডোবার পর কালপুরুষ ঠিক মাথার উপর থাকবে তখন পূর্ণিমার রাতে সে বালুবেলায় তার জন্যে অপেক্ষা করবে। আকাশে কালপুরুষ নক্ষত্র উঠেছে আর কিছুদিনের ভেতর সূর্যাস্তের সময় কালপুরুষ নক্ষত্রটি ঠিক মাথার উপর থাকবে। সেরিনার সময় এসেছে তার আব্বুর কাছে ফিরে যাবার সে তাই ফিরে যেতে শুরু করেছে।
সেরিনার বুকের ভেতর একটা চাপা বেদনা। গভীর এক ধরণের বিষণ্ণতা। সত্যি কী সে তার আঁঝুঁকে দেখতে পাবে?
.
১৬.
শামীম আকাশের দিকে তাকাল। প্রতি রাতই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের নক্ষত্রগুলোকে দেখে। কালপুরুষ নক্ষত্রটি একটু একটু করে মাঝ আকাশের দিকে এগিয়ে আসছে। তার মেয়েটি যদি বেঁচে থাকে তাহলে যখন সূর্যাস্তের সময় কালপুরুষ নক্ষত্রটি ঠিক মাথায় উপর থাকবে তখন ভরা জোছনার রাতে তার মেয়েটি সমুদ্র থেকে উঠে আসবে। শামীম সেরিনাকে বলে রেখেছিল, তার মেয়েটি কী মনে রেখেছে তার কথা? মেয়েটি কী সত্যি আসতে পারবে?