এই জাহাজটা এই এলাকায় রয়ে গেছে। তিমি মাছগুলো এদিক দিয়ে যাচ্ছে আর জাহাজ থেকে একটার পর একটা তিমি মাছ মেরে যাচ্ছে। সেরিনা একদিন খুব সাবধানে পানি থেকে মাথা বের করে দূর থেকে জাহাজটা দেখল। জাহাজের ঠিক সামনে হারপুন ছোঁড়ার কামানটা বসানো সেখান থেকে একজন মানুষ একটা তিমি মাছের দিকে তাক করে হারপুন ছুঁড়ে, তীব্রগতিতে হারপুনটা ছুটে গিয়ে তিমি মাছটাকে গেঁথে ফেলে। বিশাল একটা নিরীহ তিমি মাছ যন্ত্রণায় ছটফট করে, পানিকে তোলপাড় করে ছুটতে থাকে কিন্তু রক্ষা পায় না। সমুদ্রের পানি রক্তে লাল হয়ে যায় আর খুব ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যাওয়া তিমি মাছটাকে ধীরে ধীরে জাহাজের কাছে টেনে আনে। কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার, দেখে সেরিনার ভেতরে অন্ধ রাগ পাক খেয়ে উঠতে থাকে।
একদিন সে খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলল। জাহাজ থেকে হারপুন ছুঁড়ে যখন মাঝারী একটা তিমি মাছকে গেঁথে ফেলেছে, মাছটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে তখন তার ভেতরে সে তিমি মাছটার কাছে গিয়ে তার ধারালো চাকুটা দিয়ে হারপুনের দড়িটা কেটে দিল। শক্ত নাইলনের দড়ি, সেটা কাটা মোটেও সহজ ছিল না, কিন্তু তারপরেও কীভাবে কীভাবে জানি সে শেষ পর্যন্ত দড়িটা কেটে ফেলতে পারল। সাথে সাথে হারপুন গাঁথা তিমি মাছটা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ছুটে পালিয়ে গেল।
জাহাজের তিমি শিকারীরা খুব অবাক হয়ে দড়িটা গুটিয়ে আনে, অবাক হয়ে লক্ষ্য করে নাইলনের দড়িটা নিখুঁতভাবে কেটে দেয়া হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব তারা কেউ বুঝতে পারল না।
ঘণ্টা খানেক পর দ্বিতীয় বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটল, সেরিনা অবাক হয়ে দেখল হারপুন গাঁথা তিমি মাছটা তার কাছে এসে তার মুখ দিয়ে ঠেলে তাকে হারপুনটার কাছে পাঠাচ্ছে, তাদের নিজেদের ভাষায় প্রায় কান্নায় মতো এক ধরণের শব্দ করছে। আরো কয়েকটা তিমি মাছ তাকে ঘিরে ঘুরছে। ইঙ্গিতটা খুবই স্পষ্ট, সেরিনাকে হারপুনটা খুলে দিতে হবে।
সেরিনা জীবনেও একটা হারপুন নিজের চোখে দেখে নি, যখন একটা তিমি মাছের শরীরে একটা হারপুন গেঁথে যায় তখন সেটাকে আদৌ টেনে বের করা সম্ভব কী না সে জানে না। কিন্তু যখন পাহাড়ের মতো তিন চারটা তিমি মাছ সেরিনার মতোন ছোট একটা মানুষকে ঘিরে মুখ দিয়ে ঠেলে হারপুনটা খুলে দেয়ার জন্যে ঠেলে দিতে থাকে তখন তার আর কিছু করার থাকে না। তার এই ছোট জীবনে সে এর মাঝে এতোকিছু করেছে তার সাথে না হয় আরো একটা ঘটনা যুক্ত হোক। সে তার কোমর থেকে টাইটেনিয়ামের ধারালো চাকুটা নিয়ে কাজে লেগে যায়।
সত্যি সত্যি সেরিনা হারপুনটা খুলে আনতে পারবে, নিজেও বিশ্বাস করে নি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা সে করতে পারল। তিমি মাছের শরীরে অনেক চর্বি, সেই চর্বি কেটে ভেতরে গিয়ে সেরিনা হারপুনের ধারালো ফলাগুলো ছুটিয়ে সাবধানে বের করে আনে। পুরো পানিটা রক্তে লাল হয়েছিল বলে তার দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল। মাঝে মাঝেই হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুমান করতে হচ্ছিল হারপুনে ফলাটা কোনদিকে। পুরো সময়টা তিমি মাছটা যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, অন্য তিমি মাছগুলো তখন তার আশেপাশে থেকে তাকে শান্ত করে রেখেছে।
শেষ পর্যন্ত যখন হারপুনটা খুলে আনতে পেরেছে তখন তিমি মাছগুলো এক ধরণের আনন্দের শব্দ করল। যে তিমি মাছটার শরীরে হারপুন গেঁথে ছিল সেটি ঘুরে এসে খুব কাছ থেকে সেরিনাকে দেখলো, তার চোখটা এতো জীবন্ত যে সেরিনা এক ধরণের শিহরণ অনুভব করে। তারপর তার মুখ দিয়ে সেটি সেরিনাকে স্পর্শ করল তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার একটা পদ্ধতি।
তিমি মাছেরা নিশ্চয়ই নিজেরা নিজেদের ভেতর কথা বলতে পারে কারণ এই ঘটনার পর সেরিনা আবিষ্কার করল, বিশাল বিশাল তিমি মাছ তাকে দেখলেই থেমে যেতে শুরু করেছে। মাথা ঘুরিয়ে তার কাছে এসে মুখ দিয়ে তাকে স্পর্শ করছে, ফ্লিপারটি তার শরীরের উপর বুলিয়ে নিচ্ছে, মুখ দিয়ে নরম কোমল এক ধরণের শব্দ করছে। নিশ্চয়ই তিমি মাছেরা নিজেদের ভেতর সেরিনাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করছে, একজন অন্যজনকে জানিয়ে দিচ্ছে মানুষের মতো দেখতে ছোট একটা প্রাণী তিমি মাছের বন্ধু সেই মানুষটি তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাই তিমি মাছগুলো তাকে দেখলে একটু থেমে গিয়ে তার সাথে একটু ভাব বিনিময় করে যায়।
কয়দিন পর আরো বড় একটা জাহাজ এল তিমি মাছ মারার জন্যে। একটি দুটি তিমি মাছকে মেরেও ফেলল। এরা শুধু যে হারপুন দিয়ে গেঁথে ফেলে তা না, তারপর শক্তিশালী রাইফেল দিয়ে গুলি করে তিমি মাছগুলোকে দ্রুত মেরে ফেলে। সেরিনা চেষ্টা করেও কোনো তিমি মাছ। রক্ষা করতে পারল না।
রাতে জাহাজটা নোঙ্গর ফেলেছে। তখন সেরিনা ঘুরে ঘুরে জাহাজটাকে খুব ভালো করে দেখল। সারাদিন কাজ শেষ করে তিমি শিকারীরা ঘুমানোর আগে স্ফূর্তি করছে, তাদের হই হল্লা অনেকদূর থেকে শোনা যায়।
জাহাজের গলুইয়ে লাগানো হারপুন ছোঁড়ার কামানটা দেখা যাচ্ছে, কোনোভাবে যদি এটাকে নষ্ট করে দেয়া যেতো তাহলে এরা আর তিমি মাছ মারতে পারতো না। হারপুন ছোঁড়ার কামানটা দেখতে দেখতে হঠাৎ সেরিনার মাথায় একটা বুদ্ধি উঁকি দিয়ে গেল। তিমি মাছদের ব্যবহার করে সে কী এই কামানটাকে উপড়ে ফেলতে পারে না?