মাছের ঝাঁক থেকে মাছ খেয়ে ডলফিনের দলটা সমুদ্রের পানিতে ছোটাচ্চুটি করতে লাগল। হঠাৎ এক সময় একটা ডলফিন শীষের মতো শব্দ করে সবাইকে সতর্ক করে দেয়, ঠিক কী জন্যে সতর্ক করেছে সেরিনা বুঝতে পারল না, সে আশে পাশে তাকালে তখন দেখল দূর থেকে একটা হাঙ্গর মাছ আসছে। এই প্রাণীটাকে সেরিনা আসলেই ভয় পায়। সে নিঃশব্দে পানিতে ভেসে থাকল, কখন এটি কাকে আক্রমণ করে বসবে ঠিক নেই, এর মুখটা দেখেই আতংক হয়, সেটা কেমন জানি হিংস্র, ধারালো দাঁত দিয়ে মুহূর্তের মাঝে যে কোনো কিছু দু টুকরা করে ফেলতে পারে। আগেও তার মাঝে মাঝে হাঙ্গর মাছের সাথে দেখা হয়েছে, প্রতিবারই সে নিঃশব্দে ভেসে থেকেছে, হাঙ্গর মাছটি তখন পাশ দিয়ে, সাঁতরে চলে গেছে। চুপচাপ থাকলে মনে হয় হাঙ্গর মাছ সেটাকে ভালো দেখতে পায় না।
সেরিনা সাবধানে তার চাকুটা ধরে রাখল, সত্যি সত্যি তাকে আক্রমণ করলে এমনি এমনি সে ছেড়ে দেবে না। হাঙ্গরটা তাকে আক্রমণ করল না, ডলফিনগুলোকেও ধরার চেষ্টা করল না, লেজটা ডানে বায়ে নাড়তে নাড়তে আরো গভীর পানির দিকে নেমে গেল।
হাঙ্গরটা চলে যাবার পর ডলফিনগুলোও আবার খেলতে শুরু করে। সমুদ্রে থাকা শুরু না করলে সে কোনোদিন জানতে পারতো না ডলফিন এতো হাসিখুশি প্রাণী! মাঝে মাঝে মনে হয় এদের বুঝি মানুষের মতোই বুদ্ধি! সে যদি একবার তার আব্বুকে এনে এই ডলফিনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতো তাহলে কী মজাই না হতো!
সে বলতো, “আব্বু এই হচ্ছে টুশকিকে।“
টুশকি একটা ছোট লাফ দিতো আর আব্বু বলতো, “কী খবর টুশকি?”
তখন সে টুশকির মাকে দেখিয়ে বলতো, “আব্বু, এই হচ্ছে টুশকির মা। আমি এর দুধ খাই।”
আব্বু বলতো, “আমার মেয়েকে দেখেশুনে রাখার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ টুশকির মা!”
সেরিনা একটা নিশ্বাস ফেলে, মাঝে মাঝে তার খুব আব্বুর কথা মনে হয়।
সেরিনা প্রথম যেদিন তিমি মাছ দেখেছিল সেই দিনটার কথা সে ভুলতে পারবে না। ডলফিন যেরকম হাসিখুশি বাচ্চাদের মতো তিমি মাছ ঠিক সেরকম গম্ভীর বয়স্ক মানুষের মতো। প্রথমবার যখন একটা তিমি মাছ দেখেছিল সে অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে ছিল। একেবারে ট্রেনের মতো বিশাল একটা প্রাণী ধীরে ধীরে যাচ্ছে। তিমি মাছটার একটা বাচ্চা, সেটাও বড় একটা বাসের মতো বড়, তার মায়ের পিছু পিছু যাচ্ছে। বিশাল একটা লেজ ধীরে ধীরে উপরে আর নিচে নামে। তিমি মাছও স্তন্যপায়ী প্রাণী এটাকেও নিশ্বাস নিতে হয়, মাঝে মাঝে মাথাটা পানির উপরে তুলে নিশ্বাস নেয় তারপর মাথার যে ফুটোটা আছে সেটা দিয়ে বাতাসটা বের করে দেয়।
সেরিনা তিমি মাছটার পিছু পিছু অনেকদূর গিয়েছিল। তিমি মাছ এতো বড় যে সেটাকে কেউ আক্রমণ করবে তার সাহস নেই। তিমি মাছ নিজেও সেটা খুব ভালো করে জানে, তাই সেটা যখন পানির নিচে দিয়ে যায় তখন ডানে বামে কোনোদিকে তাকায় না। সেরিনা জানতো না তিমি মাছ গান গাওয়ার মতো করে ডাকতে পারে। অনেকদূর থেকে যখন কান্নায় মতো শব্দ করে তিমি মাছ ডাকতে থাকে সেটা শুনে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।
এতো বড় তিমি মাছ কিন্তু সেরিনা কখনো তিমি মাছটাকে কিছু খেতে দেখে নি! মনে হয় পানির শ্যাওলা প্রাংকটন এগুলো খেয়েই থাকে। ডলফিনের মতো মাংশাসী নয়, নিরমিষাশী।
ডলফিনের সাথে সেরিনার যে রকম এক ধরণের বন্ধুত্ব হয়েছে তিমি মাছদের সাথে সেরকম বন্ধুত্ব না হলেও এক ধরণের পরিচয় হয়েছে। তিমি মাছের কৌতূহলী বাচ্চাটা সেরিনাকে দেখলেই তার দিকে এগিয়ে আসে, তাকে উল্টে পাল্টে দেখে। মা তিমি মাছটা তখন চোখের কোণ দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু একদিন তিমি মাছদের সাথে তার একধরণের ঘনিষ্ঠতা হলো। ঘটনাটা ছিল খুবই ভয়ংকর একটা ঘটনা।
.
১৪.
কয়দিন থেকেই সেরিনা একটা জাহাজের শব্দ শুনছিল। জাহাজের প্রপেলারে শব্দ বাড়ে আবার কমে। মনে হয় জাহাজটা কোনো কাজে এ দিকে এসে ঘুরোঘুরি করছে। তিমি মাছের একটা বড় দলও এদিকে ঘুরোঘুরি করছে। দেখে মনে হয় এগুলো অন্য কোনো একটা এলাকা থেকে এদিকে এসেছে। শীতের সময় যেরকম এক এলাকার পাখী অন্য এলাকায় চলে আসে অনেকটা সেরকম। জাহাজটা যে তিমি মাছ মারার জন্যে এসেছে সেটা সেরিনা মোটেও অনুমান করতে পারে নি।
ব্যাপারটা সেরিনা বুঝতে পারল যখন একদিন সে দেখল জাহাজের উপর থেকে একটা হারপুন দিয়ে বিশাল একটা তিমি মাছকে গেঁথে ফেলা হল। তিমি মাছটা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তার বিশাল শরীরটা নিয়ে পানির ভেতর দিয়ে ছুটতে থাকে আর জাহাজের উপর থেকে হারপুনের দড়ি ছাড়তে থাকে। হারপুনটা তিমি মাছের শরীরে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে সেটা আর খুলে আসার উপায় নাই। হারপুনের দড়িতে বাঁধা থেকে তিমি মাছটা পানি তোলপাড় করে ছটফট করতে থাকে। রক্তে পানিটা টকটকে লাল হয়ে যায়। তিমি মাছটা নিশ্বাস নেবার জন্য একবার উপরে উঠে আবার ডুবে যায়। পানির নিচে ছটফট করতে থাকে। তিমি মাছটা যখন শেষ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে নির্জীব হয়ে যায় তখন হারপুনের দড়ি টেনে টেনে তিমি মাছটাকে বিশাল জাহাজের কাছে নিয়ে আসে তারপর সেটাকে তখন ক্রেন দিয়ে টেনে টেনে জাহাজের উপর তুলে ফেলে। রক্তের গন্ধ পেয়ে একটু পরেই অনেকগুলো হাঙ্গর মাছ চলে এসে ঘোরাঘুরি করতে থাকে সেরিনা তখন তাড়াতাড়ি সরে গেল।