শামীম শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে উপরে তুলে আনে, শিশুটি তখনো নড়ছে। কেঁচ হাতে মানুষটা চাপা গলায় বলল, “ইয়া মাবুদ!”
শামীম বলল, “আমার ব্যাগটা খোলেন। একটা টাওয়েল আছে বের করেন তাড়াতাড়ি।”
বাবা ধরার আগেই মেয়েটা ব্যাকপেকটার জিপ টেনে খুলে ভেতরে হাতড়ে একটা টাওয়েল বের করে আনে। শামীম দ্রুত বাচ্চাটাকে টাওয়েলে
পেঁচিয়ে বলল, “এখানে হাসপাতাল কোথায় আছে?”
কোচ হাতে মানুষটা বলল, “হাসপাতাল নাই।”
“ক্লিনিক? মেডিকেল সেন্টার?”
“নাই। সদরে একজন ডাক্তার বসে–” শামীম বলল, “আমার ডাক্তার দরকার নাই। আমি ডাক্তার।”
মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, “বেঁচে আছে?”
“হ্যাঁ।“
“পানিতে ডুবে বেঁচে আছে কেমন করে?”
শামীম বলল, “আমি জানি না।”
মেয়েটা শামীমের বুকে চেপে ধরে রাখা শিশুটিকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “ছেলে না মেয়ে? ছেলে না মেয়ে?”
শামীম বলল, “খেয়াল করি নি।”
মেয়েটা বলল, “মেয়ে। মনে হয় মেয়ে।”
দেখতে দেখতে তাদের ঘিরে মানুষের ভীড় জমে গেল একজন বলল, “এইটা কার বাচ্চা?”
আরেকজন বলল, “বাচ্চাকে পানিতে ফেলেছে কেন?”
আরেকজন বলল, “কেন পানিতে ফেলেছে আপনি বুঝেন নাই? বার্লি খেয়ে বড় হয়েছেন?”
আরেকজন বলল, “কিন্তু কে? এই বাচ্চার মা কে?”
“সেইটা আপনাকে বলবে?”
তখন বেশ কয়েকজন হঠাৎ করে বাচ্চাটাকে দেখতে চাইল, বলল, “দেখি বাচ্চাটারে দেখি?”
শামীম বলল, “বাচ্চাটাকে পরে দেখা যাবে-এখন তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। এক্ষুনি।”
০২. ছোট শিশুটির বুকে স্টেথেস্কোপ
ছোট শিশুটির বুকে কিছুক্ষণ স্টেথেস্কোপটা ধরে রেখে কিছু একটা শুনে কম বয়সী ডাক্তারটি বলল, “বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।“
শামীম অবাক হল না। সে নিজে ডাক্তার, সে খুব ভালো করে জানে একটা ছোট শিশু মায়ের গর্ভে একটা উষ্ণ পরিবেশে থাকে। জন্ম হবার পর বাইরের জগৎটি তার জন্যে যথেষ্ট ঠাণ্ডা বাচ্চাকে তখন কাপড় জড়িয়ে রাখতে হয়। এই রকম একটা বাচ্চাকে যদি একটা ডোবায় ফেলে দেয়া হয় তার বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা খুব কম।
কম বয়সী ডাক্তার–যাকে দেখে একটা কলেজের ছাত্রী বলে মনে হয়, শামীমের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি নিজেও তো একজন ডাক্তার, আপনি তো আমার থেকে ভালো জানেন। বাচ্চাটির দুই লাংসেই নিমোনিয়া। অক্সিজেন দিতে হবে।”
শামীম মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চাটার চিকিৎসা কী ঠিক করে হবে?”
ডাক্তার মেয়েটি হেসে ফেলল, বলল, “এটা সরকারী হাসপাতাল সরকারী হাসপাতালের অবস্থা তো আপনি জানেন। এই রকম অবস্থায় যেটুকু পারি আমরা ততটুকু চেষ্টা করব।”
শামীম বলল, “একটা ইনকিউবিটারে রাখলে–”
মেয়েটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের ইনকিউবিটর বেশি নাই। যে কয়টি আছে তার সবগুলো এখন ব্যবহার হচ্ছে। কোনো একটা খালি হলেই নিয়ে যাব।”
“আমার তাহলে করার কিছু নেই?”
“আপনার যা করার তার সবকিছু করেছেন। একটা ডোবাতে মাত্র জন্ম হওয়া একটা বাচ্চাকে ডোবাতে ফেলে দিলে তাকে পেয়ে কেউ তুলে হাসপাতাল পর্যন্ত আনে না। আপনি এনেছেন, তার চিকিৎসা শুরু করিয়েছেন, ওষুধপত্র যা লাগবে কিনে দিয়েছেন। আপনার দায়িত্ব শেষ।”
শামীম ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “বাচ্চাটা যদি শেষ পর্যন্ত না বঁচে–”
“বেওয়ারিশ লাশকে দাফন করার খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। আপনি শুনে খুব অবাক হবেন মানুষকে আমরা অনেক সময় বাঁচাতে পারি না কিন্তু মরে গেলে যথেষ্ট যত্ন করে তাকে দাফন-কাফন করি।”
“আর যদি কোনো একটা ম্যাজিক হয়ে যায়, বাচ্চাটা বেঁচে যায়? তখন তার কী হবে?”
“এরকম ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এদের পালক নেয়ার জন্য অনেক পরিবার থাকে। যদি বেঁচে যায় তাহলে এই বাচ্চাটি সুন্দর একটা পরিবার পেয়ে যাবে।“
শামীম তবু ইতস্তত করে, “তাহলে আপনি বলছেন এই বাচ্চাটির জন্যে আমার আর কিছু করার নেই?”
“না। আপনার আর কিছু করার নেই?”
“তাহলে আমি চলে যাব?”
“হ্যাঁ। আপনি চলে যেতে পারেন।”
শামীম ছোট শিশুটির দিকে তাকালো। শিশুটির নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ছোট ছোট দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে। নিমোনিয়ার শিশুদের বেলায় যেটা সবসময়ে দেখা যায়। শামীম শিশুটির কপাল একবার স্পর্শ করে মনে মনে বলল, “ভালো হয়ে যাও।”
হাসপাতালের করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে শামীমের ভেতরে কিছু একটা খচ খচ করতে লাগল। ঠিক কোন ব্যাপারটা তার ভেতরে এরকম খচ খচ করছে সে ধরতে পারল না সেই জন্যে অস্বস্তিটা আরো বেশি পীড়া দিতে লাগল।
.
চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শামীম তার ব্যাকপেকটা নিচে রেখে ভেতরে তাকাতেই দেওয়ালে টানানো শাহানা আর রিতুর বড় ছবিটা চোখে পড়ল। দুইজনই তার দিকে তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ সে বাসায় থাকে ততক্ষণ এই দুজন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। গাড়ী একসিডেন্টে তার শরীরের প্রায় সবগুলো হাড় ভেঙ্গে গিয়েও সে বেঁচে গেল কিন্তু শাহানা আর রিতুর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই কিন্তু তারা দুজনেই মরে গেলবিষয়টা এতোদিন পরেও তাকে অবাক করে দেয়। শামীম কোনোদিন চিন্তা করে নি শাহানা আর রিতু ছাড়া সে একা একা বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু সে একা একা বেঁচে আছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই মাঝে মাঝেই তার মনে হয় শাহানা কিংবা রিতু আসলে মারা যায় নি। তারা বাসাতেই আছে। ডাক দিলেই দরজা খুলে বের হয়ে আসবে। শান্তা চোখ পাকিয়ে বলবে, “কী হলো? চিৎকার করছ কেন? তোমার সমস্যাটা কী?” আর রিতু কোনো কথা না বলে পিছন থেকে ছুটে এসে তার ঘাড়ে ঝুলে পড়বে। একটিবার–শুধু একটিবার রিতুকে দুই হাতে জাপটে ধরার জন্যে তার সমস্ত শরীর আঁকুপাঁকু করতে থাকে। শাহানার চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথা বলার জন্যে তার সমস্ত চেতনা মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন। হয়ে যায়।