তার কারণ আছে। এই দলটার সাথে তার পরিচয়টা হয়েছে প্রায় হঠাৎ করে। সমুদ্রে যখন প্রায় প্রথম এসেছে তখন হঠাৎ করে একদিন সে একটা জাহাজের শব্দ পেল। নিচ থেকে দেখল মাঝারি সাইজের একটা জাহাজ জাল ফেলতে ফেলতে যাচ্ছে। জাল ফেলে কেমন করে মাছ ধরে দেখার জন্যে সে পিছু পিছু গেল। জাহাজটা আস্তে আস্তে যখন জাল গুটিয়ে আনছে তখন দেখতে পেলো টুনা মাছের বিশাল একটা ঝাক জালের ভেতর আটকা পড়েছে, মাছগুলো জালের ভেতর খল-বল করছে। হঠাৎ করে দেখল জালের আশেপাশে অনেকগুলো ডলফিন ছুটোছুটি করছে, মুখ দিয়ে শীষ দেওয়ার শব্দ করছে। ক্লীক ক্লীক শব্দ করছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ডলফিনগুলো কোনো একটা কারণে খুবই বিচলিত, তাদের মাঝে এক ধরণের উত্তেজনা আর ভয়। কেন ডলফিনগুলো এরকম করছে দেখার জন্যে সেরিনা আরেকটু কাছে এগিয়ে গেল তখন ডলফিনগুলোর উত্তণ্ঠার কারণটা বুঝতে পারল। জালের ভেতরে টুনা মাছের সাথে ছোট বড় অনেকগুলো ডলফিনও আটকা পড়েছে। সেগুলো ভেতরে আতংকিত হয়ে ছুটোছুটি করছে, বের হওয়ার চেষ্টা করছে, একটু পরে পরে জালে ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু বের হতে পারছে না।
মাছ ধরার জাহাজটা তখন গুটিয়ে নেয়া জালটা আস্তে আস্তে উপরে তুলতে শুরু করে, টুনা মাছগুলো হুটোপুটি শুরু করে তার সাথে সাথে ডলফিনগুলোও আতংকিত হয়ে লাফ দিতে শুরু করে।
সেরিনা তখন আরেকটু এগিয়ে গেলো, তার কোমরে টাইটেনিয়ামের একটা চাকু বেঁধে রাখা আছে। সে যখন সমুদ্রে লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন শামীম তাকে এই চাকুটা দিয়েছে, টাইটেনিয়ামের বিশেষ ধরণের একটা চাকু, সমুদ্রের পানিতেও জং ধরে যাবে না। সমুদ্রের কতো রকমের প্রাণী সবারই নিজেকে রক্ষা করার জন্যে কিংবা অন্যকে আক্রমণ করার জন্যে ধারালো দাঁত বা অন্য কিছু একটা আছে, সেরিনার কিছু নেই। তার একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে তার মাথার বুদ্ধি আর টাইটেনিয়ামের এই চাকুটা।
সেরিনা চাকুটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল তারপর জালটার উপর থেকে নিচে অনেকখানি কেটে দিল। কাটা অংশ দিয়ে টুনাগুলো বের হতে লাগল আর তাদের দেখে হঠাৎ করে ডলফিন বুঝে গেল বের হওয়ার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, দেখতে দেখতে সবগুলো ডলফিন বের হয়ে আসতে থাকে। তাদের বের হতে সাহায্য করার জন্যে সেরিনা কাটা জালটা টেনে ধরে রেখে জায়গা করে দিল।
মাছ ধরার জালটা যখন উপরে টেনে তুলেছে তখন ডলফিনের সাথে সাথে বেশীরভাগ টুনাও বের হয়ে গেছে। জাহাজের মানুষগুলোকে নিচ থেকে দেখার উপায় নেই কিন্তু সেরিনা অনুমান করতে পারল মানুষগুলো নিশ্চয়ই তাদেও ফাটা জাল দেখে খুবই অবাক হয়ে গেছে।
ডলফিনগুলো চলে গেল না, সেরিনার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগল, বোঝাই যাচ্ছে তারা সেরিনাকে তাদের নিজেদের মতো করে ধন্যবাদ জানাতে চাচ্ছে। ডলফিন স্তন্যপায়ী প্রাণী, পানিতে থাকলেও তাদের উপরে উঠে নিশ্বাস নিতে হয়, তাদের মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি। আটকে পড়া ডলফিনগুলোকে সেরিনা কীভাবে ছুটিয়ে এনেছে তারা ঠিক বুঝতে পেরেছে। একটা ডলফিন খুব কাছে এসে সেরিনার মুখ স্পর্শ করল, মনে হলো তার গালে চুমু দেবার চেষ্টা করছে। পিছনে ছোট একটা ডলফিনের বাচ্চা, সেরিনা বুঝতে পারল বাচ্চাটা ভেতরে আটকা পড়েছিল, এখন ছাড়া পেয়েছে বলে মা’টা সেরিনাকে তার মত করে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।
সেরিনা ডলফিনটাকে ধরে একটু আদর করে দিল এবং সেই মুহূর্ত থেকে সে এই ডলফিনের দলের একজন সদস্য হয়ে গেল। ছোট ডলফিনটা তার খুবই ন্যাওটা হয়ে গেছে, সেরিনা তার নাম দিয়েছে টুশকি। প্রতিদিন ভোরেই ঘুম থেকে উঠে টুশকি তার কাছে চলে আসে। আজকেও এসেছে।
.
কিছুক্ষণের মাঝেই ডলফিনের দলটা অগ্রসর হতে শুরু করে। এরা যখন মাছ ধরতে যায় তখন একসাথে না থেকে অনেক দূরে দূরে ছড়িয়ে যায়। ডলফিনগুলো পানির ভেতর দিয়ে যেভাবে সাঁতার কাটতে পারে ঠিক সেরকম লাফ দিয়ে পানি থেকে বের হয়ে আসে। ডলফিনগুলোর পাশাপাশি সাঁতার কেটে যেতে যেতে সে যদি কখনো পিছিয়ে পড়ে তখন ডলফিনগুলো তার জন্যে অপেক্ষা করে। সেরিনা কখনো কখনো আরেকটা ডলফিনের পিঠে চেপে বসে সেটি তাকে নিয়ে সাঁতারে যেতে থাকে।
টুশকির পাশে পাশে সাঁতরে যেতে যেতে সেরিনা টের পেলো সামনে তারা একটা মাছের ঝাঁক পেয়েছে। ডলফিনগুলো চারদিক থেকে মাছের আঁকটাকে ঘিরে ফেলে তারপর মাছের আঁকটাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘূরপাক খেতে থাকে। ডলফিনগুলো ধীরে ধীর বৃত্তটাকে ছোট করে আনে যখন বৃত্তটা মাছগুলো ধরার মতো ছোট হয়ে আসে তখন ডলফিনগুলো মাছ ধরে খেতে শুরু করে। এগুলো স্মেল্ট মাছ, বেশি বড় নয়। সেরিনা ডলফিনের মতো মাছ খেতে শিখে গেছে। ডলফিনগুলো সরাসরি মুখ দিয়ে খাচ্ছে সেরিনা মাঝে মাঝে উলফিনের মতো চেষ্টা করে দেখেছে, খুব সুবিধে করতে পারে না। তাকে সবসময়েই হাত দিয়ে ধরে নিতে হয়। গোটা তিনেক স্মেল্ট খেয়েই তার পেট ভরে গেল। সে যেভাবে কাঁচা মাছ ধরে খাচ্ছে তার আব্বু দেখলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যেতো। সমুদ্রে আসার পর এটাই সে প্রথমে শিখেছে। প্রথম প্রথম গন্ধে নাড়ী উল্টে আসতো আজকাল বেশ অভ্যাস হয়ে গেছে। চিংড়ি, কাঁকড়া আর ওয়েস্টার তার প্রিয় খাবার। ডলফিন স্কুইড খেতে পছন্দ করে সেও তাদের মতো স্কুইড খাওয়া শিখে গেছে। কাঁচা মাছ খুবই বিচিত্র খাবার হতে পারে না, জাপানীরা সুশী খায় সুশী তো কাঁচা মাছ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রথম প্রথম তার খাওয়াটা ছিল বেঁচে থাকার জন্যে আজকাল যখন খুব খিদে লাগে তখন খাওয়াটা সে রীতিমত উপভোগ করতে শুরু করেছে।