শামীম ফিসফিস করে বলল, “মনে আছে তো মা, যখন সূর্য ডোবার। পর কালপুরুষ নক্ষত্রটা ঠিক মাথার উপর থাকবে তখন যেদিন পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে তখন আমি ঠিক এই জায়গায় তোর জন্যে অপেক্ষা করব। চাঁদের আলোতে এখানে বসে থাকব।”
“মনে আছে আব্বু।”
পিছনে হঠাৎ অনেকগুলো মানুষের পায়ের ধুপ ধাপ শব্দ শুনতে পায়, কিছু মানুষ ছুটে আসছে। শামীম পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করল না, কারা আসছে, কতজন আসছে তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। হেলিকপ্টারের শব্দটা এখন খুব কাছে, স্পীড বোটের গর্জন আরো বেড়ে গেছে, সেগুলো এখন আবছা দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের পানি কেটে তাদের দিকে ছুটে আসছে।
তার মাঝে সেরিনা এক পা এক পা করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার মাঝে কোনো ব্যস্ততা নেই। বড় একটা ঢেউ এসে সেরিনাকে আড়াল করে দিল, ঢেউটা সরে যেতেই আবার সেরিনাকে দেখা গেল, জোছনায় আলোতে সেরিনা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। শামীম তাকিয়ে রইল, সেরিনা আবছা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আরো একটি বড় ঢেউ এল তারপর আর সেরিনাকে দেখা গেল না।
অনেকগুলো মানুষের গলায় আওয়াজ শুনতে পেল শামীম, কেউ একজন খপ করে তার ঘাড়ে ধরেছে, “কোথায়? কোথায় গেছে মেয়েটা।”
শামীম ঘাড় ধরে রাখা মানুষটার হাত সরিয়ে বলল “চলে গেছে।”
“কোথায়? কোথায় গেছে মেয়েটা?”
“সমুদ্রে।”
“কখন আসবে?”
“আর আসবে না।” বলে শামীম ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে থাকে। ঠিক তখন বিকট গর্জন করে একটা স্পীডবোট পানি থেকে প্রায় লাফিয়ে বালুবেলায় উঠে যায়। সেখান থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ লাফিয়ে নেমে শামীমের দিকে ছুটে আসতে থাকে। একজন চিৎকার করে বলল, “থাম।”
শামীম থামল না। মানুষটা বলল, “না থামলে গুলি করে দেব।”
শামীম হাঁটতে হাঁটতে বলল, “দাও। গুলি করে দাও। আমি চাই তোমরা কেউ একজন আমাকে গুলি করে দাও। আমার আর ভালো লাগছে না।”
কেউ গুলি করল না। শামীম একবারও পিছনে না তাকিয়ে হেঁটে যেতে থাকল।
.
সেরিনা তখন সমুদ্রের গভীরে সাঁতরে যেতে থাকে। তার চোখের লোনা পানি সমুদ্রের লোনা পানির সাথে মিশে যাচ্ছিল।
পুরো সমুদ্রটাই কী তার মতো দুঃখী মানুষের চোখের পানিতে তৈরী হয়েছে?
১৩-১৪. একটু পর পর কিছু একটা
একটু পর পর কিছু একটা সেরিনার পেটে ঢুশ মারছে, সেরিনা আধো ঘুমে হাত দিয়ে সেটাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল কিন্তু সেটি সরল না। সেরিনা শেষ পর্যন্ত চোখ খুলে তাকালো, প্রাণীটি টুশকি, একটি ডলফিনের বাচ্চা। ডলফিনের যে দলটির সাথে সেরিনা সময় কাটায় এই শিশুটা সেই দলের। সেরিনা এর নাম দিয়েছে টুশকি, ডলফিন শিশুটা এই নামে সাড়া দেয়।
সেরিনা চোখ খুলে বলল, “টুশকি, তোমার সমস্যাটা কী? পানির ভেতর সেরিনার কণ্ঠস্বর অন্য রকম শোনায় কিন্তু তাতে টুশকির কোনো সমস্যা হলো বলে মনে হলো না। টুশকি একটা শীষ দেওয়ার মতো শব্দ করল তারপর মুখ দিয়ে টিক টিক করে শব্দ করতে লাগল।
সেরিনা ডলফিনের ভাষা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছে। প্রত্যেকটা ডলফিনের নিজের একটা শীষ আছে সে শীষের শব্দ শুনে বুঝতে হয় কে কথা বলছে। টিক টিক শব্দ করে তারা কথা বলে, যখন মাছ ধরতে যায় তখন এক ধরণের শব্দ যখন খেলতে চায় তখন অন্য ধরণের শব্দ।
সেরিনা বলল, “কেন এতো ভোরে তুমি জ্বালাতন করছ? তোমার বেশীক্ষণ ঘুমাতে হয় না তার মানে এই না যে আমাকে ঘুমাতে হবে না।”
টুশকি কী বুঝল কে জানে, তার মাঝে এক ধরণের আনন্দ আর উত্তেজনা দেখা গেল। সেটি কয়েকবার সামনে পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে একবার উপরে উঠে নিশ্বাস নিয়ে আবার নিচে নেমে এল! সেরিনাকে না। নিয়ে সেটি যাবে না। সেরিনা তখন বাধ্য হয়ে পাথরের খাঁজ থেকে বের হয়ে আসে তারপর ডলফিল শিশু টুশকির সাথে পানির উপরে উঠে এল।
পানির নিচের আবছা অন্ধকার থেকে উপরে উঠে সেরিনার চোখ ধাঁধিয়ে যায়, চারদিকে যতদূর চোখ যায় সমুদ্রের নীল পানি, উপরে নীল আকাশ। এক দল ডলফিন নিশ্বাস নেবার জন্যে তাদের মাথাটা বের করে ঘুমুচ্ছে। নিজেদের ভাসিয়ে রাখার জন্যে ঘুমর মাঝেই খুব ধীরে ধীরে তাদের লেজ নাড়ছে।
টুশকি সেরিনাকে ঘিরে সাঁতার দিতে দিতে ঘুরপাক খেতে লাগল। মাঝে মাঝে পানি থেকে লাফিয়ে উপরে উঠে যেতে লাগল। টুশকির দাপাদাপিতে অন্য ডলফিনগুলোও জেগে উঠে নড়তে শুরু করল। সেরিনা তাদের শীষের শব্দ শুনতে পায়।
ডলফিনগুলো একে অন্যের সাথে ক্লিক ক্লিক শব্দ করে কথা বলতে থাকে। একটু পরেই তারা মাছ ধরতে বের হবে, সেরিনা সব সময়েই তাদের সাথে যায়। যাবার আগে তার একটু খাওয়া দরকার। সদ্য বাচ্চা দেয়া মা ডলফিনটার শীষের শব্দ অনুসরণ করে সে কয়েকবার শব্দ করল, তখন একটা মাঝারী সাইজের ডলফিন তার দিকে এগিয়ে এসে মাথার উপরের ফুটো দিয়ে বড় একটা নিশ্বাস ফেলল। সেরিনা ডলফিনটাকে চিনতে পারল, সে এটাকেই খুঁজছে।
সেরিনা পানিতে ডুবে গিয়ে মা ডলফিনটার পেটের নিচে দুধের বোঁটা খুঁজে মুখ লাগিয়ে দুধ খেতে শুরু করে। ডলফিনের দলটা তাকে গ্রহণ করার পর সে প্রায় নিয়মিতভাবে ডলফিনের দুধ খায়। সুস্বাদু গাঢ় দুধ একটু খানি খেলেই তার পেট ভরে যায়। ডলফিনের দলে যোগ দেয়ার পর এটা তার সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে। ডলফিনগুলো তাকে খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে দলের সবচেয়ে বদরাগী ধরণের পুরুষ ডলফিনটাও তাকে মেনে চলে।