“যায় আব্বু। আমি হয়েছি। তুমি আমাকে রেডি করেছ। তুমি আমাকে সমুদ্রের কাছে এই সুন্দর দ্বীপটাতে নিয়ে এসেছ। যখন ওরা আমাকে ধরতে আসবে তখন আমি সমুদ্রের মাঝে লুকিয়ে যাব! পানির নিচে ওরা আমাকে খুঁজে পাবে না। বেশী দিন নয় আব্বু মাত্র এক বছর!”
“মাত্র এক বছর?” শামীম কেমন যেন হাহাকারের মতো শব্দ করল।
“হ্যাঁ, আব্বু এক বছর পর ট্রাকিওশানের ব্যাটারী ফুরিয়ে যাবে তখন আবার আমি ফিরে আসব। তখন তারা আর আমাকে ধরতে পারবে না।”
শামীম কিছু না বলে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটাকে সে রক্ষা করতে পারল না। পৃথিবীর দানবেরা তার এই ছোট মেয়েটিকে তার বুকের ভেতর থেকে কেড়ে নিল।
সেরিনা শামীমের দিকে একটু ঝুঁকে নিচু গলায় বলল, “আব্বু তুমি আমাকে রেডি করেছ। আকাশের সব নক্ষত্র চিনিয়ে দিয়েছ যেন আমি রাতের আকাশ দেখে সময় বলতে পারি। পৃথিবীর কোথায় আছি জানতে পারি। তুমি আমাকে পৃথিবীর সমুদ্রের স্রোত শিখিয়েছ, জাহাজের পথ শিখিয়েছ। তুমি আমকে সমুদ্রের সব প্রাণীদের চিনিয়েছ–আলু বিশ্বাস কর
আমি এখন খুব আগ্রহ নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার জন্যে অপেক্ষা করছি।”
শামীম জানে সেরিনা এই কথাগুলো বলছে তাকে শান্তনা দেবার জন্য কিন্তু তবুও সে কথাগুলো বিশ্বাস করতে চাইল। শামীম ফিস ফিস করে বলল, “আমি তোকে রক্ষা করতে পারলাম না মা। অনেক চেষ্টা করেছি মা–”
“আমি জানি তুমি কতো চেষ্টা করেছ–কিন্তু তুমি আমাকে রক্ষা করেছ আব্বু–তারা আমাকে ধরে নিতে পারবে না। আমি সমুদ্রের মাঝে লুকিয়ে যাব! আর আমাকে খুঁজে পাবে না।”
শামীম ফিসফিস করে বলল, “তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস মা–”
সেরিনা বলল, “তুমি এভাবে কথা বল না আব্বু। প্লীজ তুমি এভাবে কথা বল না। তাহলে আমি কিন্তু কাঁদতে আরম্ভ করব।”
শামীম বলল, “না। তুই কাদিস না।”
“আমার জন্যে তুমি একটুও চিন্তা করো না আব্বু। তুমি জান আমি মাটির ওপরে যতটুকু সহজে থাকতে পারি তার চাইতে অনেক সহজে পানির নিচে থাকতে পারি। একটা বিলের নিচেই কতো কী থাকে আর সমুদ্রের তলায় কতো কী থাকবে তুমি চিন্তা করতে পার আব্বু? তোমার জানতে ইচ্ছে করে না? এক বছর পর এসে আমি তোমাকে বলব! তখন তুমি আর আমি আবার একসাথে থাকব! মাত্র এক বছর আব্বু!”
শামীম কোনো কথা না বলে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল। আলেক্স তাকে বলেছিল সেরিনাকে যেন এক সাথে বেশীদিন পানির নিচে থাকতে না দেয় তাহলে ধীরে ধীরে সে ফুসফুস ব্যবহার করা ভুলে যাবে। এক বছর যদি পানির নিচে থাকে তাহলে কী সে আবার শুকনো মাটির ওপর ফিরে আসতে পারবে? শামীম জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল। কোনো কথা না বলে সেরিনার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল।
সেরিনা নিচু গলায় বলল, আলু, “এই মাত্র আরেকজন মানুষ ঢুকেছে। মানুষটা আগের জনের সাথে বসেছে। আমাদের এখন উঠে যেতে হবে, আর দেরী করা যাবে না।
শামীম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আয় যাই।”
দুজন যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল তখন তাদের টেবিল থেকে দুই টেবিল পিছনে বসে থাকা মানুষ দুজনও উঠে দাঁড়াল। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে তারাও সেরিনা আর শামীমের পিছু পিছু হটতে থাকে।
এই দ্বীপটি নির্জন। শীতের কয়েক মাস অনেক পর্যটক এসে ভীড় করে তারপর হঠাৎ করে পর্যটকদের ভীড় কমে গিয়ে দ্বীপটা নির্জন হয়ে যায়। এখন দ্বীপটিতে বাইরের মানুষ বলতে গেলে কেউ নেই। বালু বেলায় যতদূর চোখ যায় কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। অনেক দূরে কয়েকটা জেলে নৌকা সমুদ্রের ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে। সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগে কিন্তু পূর্ণিমার ভরা চাঁদ উঠেছে আকাশে, জোছনার আলোতে চারিদিক থই থই করছে।
বালুতে পা গেঁথে যাচ্ছিল, তখন সেরিনা পা থেকে স্যান্ডেল খুলে নিল, তার আর স্যান্ডেলের দরকার নেই। পায়ের তলায় বালুর অনুভূতিটা অন্যরকম, সেরিনার বুকের ভেতর অতীতের এক ধরণের স্মৃতি নিয়ে আসে কিন্তু সেই স্মৃতিটা কবেকার সে মনে করতে পারে না।
শামীম হাত দিয়ে সেরিনাকে ধরে রেখেছে, সেরিনাও তার হাত দিয়ে তার আবুকে ধরে রেখেছে। দুজনেই জানে একটু পর একজনের আরেকজনকে ছেড়ে দিতে হবে তারপর কেউ কাউকে দেখতে পারবে না, স্পর্শ করতে পারবে না। কোনো কথা না বলে হেঁটে হেঁটে দুজন সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়ালো। জোয়ার শুরু হয়েছে, ঢেউগুলো একটু পর পর বালু বেলায় আছড়ে পড়তে শুরু করেছে।
শামীম আর সেরিনা দাঁড়িয়ে গেল, বড় একটা ঢেউ এসে দুজনের পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। শামীম মাথা ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকায়, দূরে কয়েকটা ছায়ামূর্তির মতো দেখা যাচ্ছে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অনেক দূরে একটা চাপা গুঞ্জন, মনে হয় একটা হেলিকপ্টার। সাথে সাথে শক্তিশালী কয়েকটা ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ছে কমছে, মনে হয় বেশ কয়েকটা স্পীড বোট
এদিকে আসছে। আসুক–এখন আর কিছুতেই কিছু আসে যায় না।
সেরিনা তার আব্বুকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “আব্বু, আমি যাই?”
শামীম বলল, “যাই বলতে হয় না মা। বলতে হয় আসি।”
সেরিনা বলল, “আবু আমি আসি?”
“আয় মা।” শামীম সেরিনাকে ছেড়ে দিল, হঠাৎ তার বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে কিন্তু সে সেরিনাকে বুঝতে দিল না। সেরিনা শেষবার তার আব্বুকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে ছেড়ে দেয়।