কেউ কোনো উত্তর দিল না? শুধু একটা চাপা হাসির শব্দ শোনা গেল।
ঠিক তখন কেউ একজন হাতের টর্চ লাইট জ্বালালো, সেরিনার ঘরটা মোটামুটি আলোকিত হয়ে যায়। সেরিনা দেখল তার ঘরের মাঝখানে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দুজন মানুষ তার আব্বুকে দুই পাশ থেকে ধরে রেখে টেনে টেনে আনছে।
শামীম হাহাকারের মতো শব্দ করে জিজ্ঞেস করল, “সেরিনা! মা, তুই ঠিক আছিস?”
সেরিনার মুখ চেপে ধরে রেখেছে বলে সে ঠিক করে কথা বলতে পারল না, অস্পষ্ট একটা শব্দ করল। শামীম ছুটে আসতে চাচ্ছিল কিন্তু মানুষ দুইটা তাকে আসতে দিল না, শক্ত করে ধরে রাখল। শামীম আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? কী চাও?”
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা শামীমের মুখে টর্চ লাইটের আলো ফেলে বলল, “আমরা তোমার সহযোগিতা চাই।”
কথাটা এমনভাবে বলল যে শুনে ঘরের সবাই হেসে উঠল যেন খুব মজার একটা কথা বলেছে!
শামীম জিজ্ঞেস করল, “কী সহযোগিতা?”
“আমরা তোমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি। তুমি সেই ব্যাপারে সহযোগিতা কর। একটা শব্দ না করে এই চেয়ারটাতে বস। আমরা তোমাকে বেঁধে রেখে যেতে চাই।”
শামীম প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, “কেন? তোমরা কেন আমার মেয়েকে নিতে চাও?”
মানুষটা বলল, “আমরা ছোট মানুষ, বড় ব্যাপার জানি না। শুধু টের পেয়েছি এটা ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্ট। তোমার মেয়ে ছোট হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রতি তোলা রক্ত নাকি মিলিওন ডলারে বিক্রি হবে!”
একজন বলল, “শুনে মনে হচ্ছে আমরাও কয়েক তোলা রক্ত রেখে দিই।”
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বলল, “খবরদার। ঠাট্টা করেও এরকম কথা বলবে না। কড়া নির্দেশ এই মেয়ের যেন কোনো ক্ষতি হয়।”
যে মানুষটা সেরিনাকে ধরে রেখেছিল সে এবারে তাকে ধরে বিছানা থেকে নিচে নামাল, সেরিনা ভাঙ্গা গলায় ডাকল, “আব্বু।”
শামীম নিচু গলায় বলল, “মা, আমার।”
শামীম বলতে চাইল, সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু বলতে পারল না। সে আবছা অন্ধকারে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল।
মানুষগুলো ধাক্কা দিয়ে শামীমকে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তারপর একজন তার মুখে একটা চওড়া মাস্কিং টেপ লাগিয়ে দেয়। তারপর হাত দুটো পিছনে নিয়ে শক্ত করে বাঁধতে থাকে।
সেরিনা দৃশ্যটি দেখতে পারছিল না, হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আবু সব আমার জন্যে হচ্ছে। সব আমার দোষ! আমার!”
শামীম বলতে চাইছিল, “তোর কোনো দোষ নেই!” কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না, সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল।
সেরিনাকে ধরে যখন পুরো দলটি ঘর থেকে বের হয়েছে তখন রাত তিনটা বাজে। বাইরে একটা গাড়ী অপেক্ষা করছিল সেখানে সেরিনাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষগুলো গাড়ীর সামনে পিছনে উঠে যায়। সাথে সাথেই গভীর রাতের নির্জন রাস্তা দিয়ে গাড়ীটা ছুটে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই গাড়ীটা শহরের এক পাশে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বড় একটা বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে গেল। গাড়ী থামার সাথে সাথে ভেতর থেকে আরো কয়েকজন মানুষ বের হয়ে আসে, তারা গাড়ীর দরজা খুলে সেরিনাকে ধরে টেনে বিল্ডিংয়ের ভিতরে নিয়ে যায়।
দোতলার একটা বড় ঘরে হাসপাতালের বিছানার মতো একটা বড় বিছানা তার চারপাশে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। সেরিনাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার সাথে সাথে তার দুই হাত আর পা এক ধরনের স্ট্র্যাপ দিয়ে বিছানার সাথে বেঁধে ফেলা হল।
একটু পরে ঘরে একজন বিদেশী মানুষ এসে ঢুকল। সেরিনা তাকে দেখেই চিনতে পারল। এই মানুষটিকেই সে তার ক্লাশ রুম থেকে মাইক্রোবাসে বসে থাকতে দেখেছে। সে যখন তার আব্বুর সাথে বিলে গিয়েছিল তখন এই মানুষটাই স্পীডবোটে করে তার নৌকাটার চারপাশে ছুটে বেড়িয়েছিল। মানুষটা সেরিনার কাছে এসে মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তারপর ইংরেজীতে বলল, “তুমিই সেই রহস্যময়ী মেয়ে যে পানির নিচে থাকতে পার!”
ইংরেজী উচ্চারণটা একটু অন্যরকম, তারপরও সেরিনা কথাটা বুঝতে পারল। সে কিছু বলল না, মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, মানুষটা এরপর হড়বড় করে আরও অনেক কিছু বলল যার সে বিশেষ কিছু বুঝতে পারল না। পাশে দ্রলোকের মতো দেখতে একটা বাঙালি মানুষ দাঁড়িয়েছিল সে বলল, “স্যার বলছেন, তোমার এতো বিস্ময়কর ক্ষমতা। তুমি কেমন করে এই পোড়া দেশে পড়ে থাকবে। তোমাকে নিয়ে বিলিওন ডলারের রিসার্চ হবে ট্রিলিওন ডলারের ব্যবসা হবে।”
সেরিনা বলল, “আমি ওসব কিছু চাই না। আমাকে ছেড়ে দেন আমি বাসায় যাব।”
বিদেশীটা মাথা এগিয়ে জানতে চাইল সেরিনা কী বলছে, মানুষটি তখন তাকে সেরিনার কথাটা ইংরেজীতে অনুবাদ করে দিল। সেটা শুনে বিদেশী হা হা করে হেসে উঠল যেন কথাটা খুবই মজার কথা এবং মানুষটাকে হাসতে দেখে অন্যেরাও হাসতে শুরু করল। সেরিনা অবাক হয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল, তাদের হাসি থামার পর বলল, “আপনারা আমার আব্বুকে বেঁধে রেখেছেন, আমাকে জোর করে ধরে এনেছেন, এটা আপনারা করতে পারেন না।”
ভদ্রলোকের মতো দেখতে বাঙালি মানুষটা বলল, “আমরা সবকিছু করতে পারি। পৃথিবীর কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না। তোমার ওপর মায়া করে, তোমার বাবাকে আমরা মারি নাই! তোমার আমাদের উপর অনেক কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। বুঝেছ?”
সেরিনা বুঝল না, অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে আপনারা কী করবেন?”