বিলকিস বলল, “কাল থেকে তুই আর একা স্কুলে আসবি না। আমরা সকালে তোর বাসায় যাব। তারপর একসাথে স্কুলে আসব।”
অন্যেরা মাথা নেড়ে বিলকিসের কথায় সায় দিল। দেখে মনে হল এতোদিন পর সবাই একটা মনের মতো কাজ পেয়েছে।
দোকানের কাছে পৌঁছে চারজন দাঁড়িয়ে যায় তারপর সেরিনা কিছু একটা মনে পড়েছে সেরকম ভান করে যে দিক দিয়ে এসেছিল ঠিক সেই দিক দিয়ে ফিরে যেতে থাকে। সেরিনা এবং তার সাথে সাথে অন্য তিন জন দেখল দুটো মানুষ হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যায়। তারা তখন নিজেদের ভেতর কথা বলে একজন পকেট থেকে সিগারেট বের করে তারপর দুজনে দুটো সিগারেট মুখে দেয়, একজন পকেট থেকে ম্যাচ বের করে, সিগারেট ধরায় এবং চোখের কোনা দিয়ে সেরিনাকে লক্ষ্য করতে থাকে।
সেরিনা মানুষ দুজনকে পার করে আরো বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর মানুষ দুটো আবার ঘুরে সেরিনার পিছু পিছু হটতে থাকে।
কারো মনে আর কোনো দ্বিধা থাকে না যে সেরিনার সন্দেহ সত্যি। মানুষ দুটো আসলেই সেরিনার পিছু পিছু যাচ্ছে। কিন্তু মানুষ দুটো আসলেই কি সেরিনাকে কিডন্যাপ করার জন্য এসেছে?
সেরিনা ডানদিকে ঘুরে যেতেই বাকী তিনজনের সাথে দেখা হয়ে গেল, তারা অন্য রাস্তা দিয়ে আগেই ছুটতে ছুটতে এখানে চলে এসেছে এখন তারা এক মুহূর্তের জন্যেও সেরিনাকে একাকী ছাড়তে রাজী নয়।
গৌরী, ললিতা আর বিলকিস মিলে সেরিনাকে তার বাসায় পৌঁছে দিল। ওরা ঠিক করে নিল পরের দিন বেশ সকালেই ওরা সেরিনাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে কী করা যায় ঠিক করা হবে।
০৮. খাবার টেবিলে শামীম
খাবার টেবিলে শামীম জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার সেরিনা? তুই আজকে এতো চুপচাপ কেন?”
“না। আব্বু এমনি।” সেরিনা একবার ভাবল আব্বুকে সব কিছু খুলে বলে, কিন্তু আব্বুর মুখ দেখে তার মায়া হল। ব্যাপারটা শোনা মাত্রই আব্বু এমন দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবেন যে চিন্তা করেই সেরিনার মন খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের তিন বন্ধুর কাছে ব্যাপারটা বলে মনটা একটু হালকা হয়েছে, আগে তাদের সাথে পরামর্শ করে দরকার হলে অন্যদের বলা যাবে। আর সত্যি সত্যি একজন মানুষকে কিডন্যাপ করা এতো সোজা না কী?
শামীম জিজ্ঞেস করল, “স্কুলের লেখাপড়ার কী খবর?”
“ভালো আব্বু। কিন্তু লেখাপড়া খুব বেশী।”
“আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন লেখাপড়ার চাপ এতো বেশী ছিল। তোদের মনে হয় চাপ খুব বেশী।”
“সেই জন্যেই তো লেখাপড়ার ইচ্ছে করে না।”
“লেখাপড়া না করে করবি কী?”
সেরিনা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “পানির নিচে নিচে ঘুরে বেড়াব।”
“একা একা?”
“তুমিও থাকবে।”
“আমি? আমি কীভাবে তোর সাথে পানির নিচে থাকব?”
“তুমি থাকবে একটা নৌকায়। উপরে, আমি পানির নিচে ঘুরে ঘুরে তোমার জন্যে আজব আজব ফলমূল মাছ, শামুক ঝিনুক এই সব নিয়ে আসব।”
শামীম একটু অবাক দৃষ্টিতে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা আজকাল মাঝে মাঝেই বলে যে তার পানির নিচে নিচে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে। একবার সত্যি সত্যি তাকে নিয়ে কোনো একটা সমুদ্রে গেলে হয়। ঠিক কী কারণ জানা নেই বিষয়টা চিন্তা করেই শামীমের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
.
রাতে সেরিনার ঘুম আসছিল না। ভেতরে একটা চাপা দুশ্চিন্তা, বিছানায় অনেকক্ষণ শুয়ে এপাশ ওপাশ করেছে। আব্বু খাবার টেবিলে বসে তার লেখাপড়া করছেন। বাইরে ঝি ঝি ডাকছে, মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা মাছ পুকুরে ঘাই মারে–বিছানায় শুয়ে সেরিনা অনুমান করতে পারে ঠিক কোন মাছটা ঘাই মেরেছে।
শেষ পর্যন্ত সে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘুম ভাঙ্গার পর সেরিনার অনেকক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব থাকে কিন্তু এখন কী হল কে জানে সেরিনা পুরোপুরি জেগে গেল। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, হঠাৎ করে সেরিনার মনে হল সেই অন্ধকারে কয়েকটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে নড়াচড়া করছে। আতংকে একটা চিৎকার দিতে গিয়ে সেরিনা থেমে গেল। সেরিনা বিছানায় কাঠ হয়ে শুয়ে কী হয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
সেরিনা দেখল একটা ছায়ামূর্তি তার বিছানার কাছে এগিয়ে আসছে, মশারিটা তুলে হঠাৎ করে তার একটা ফ্ল্যাশ লাইটের আলো মুহূর্তের জন্যে তার চোখ ধাধিয়ে দেয়। আলোটা সাথে সাথে নিভে গেল, কেউ একজন বলল, “পেয়েছি।”
সেরিনা টের পেল, পাথরের মতো একটা হাত খপ করে তার মুখ। চেপে ধরে বলল, “একটা শব্দ করেছ তো গুলি করে ঘিলু বের করে দেব।”
সেরিনা তার কপালে শীতল একটা ধাতব নলের স্পর্শ পেল। নিশ্চয়ই রিভলবার। ভয়ংকর আতংকে সেরিনার সারা শরীর শীতল হয়ে যায়। ঠিক করে সে চিন্তাও করতে পারে না।
অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে ভারী একটা গলা বলল, “বাপটাকে নিউট্রলাইজ কর। মনে রেখো নো ব্লাড শেড।”
সেরিনা দেখল তার ঘর থেকে কয়েকটা ছায়ামূর্তি বের হয়ে গেল এবং কয়েক সেকেন্ড পরেই সে তার আব্বুর গলার স্বর শুনতে পায়, একটা ধস্তাধস্তির শব্দ হয় এবং একজন মানুষ যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। সেরিনা শুনল পাশের ঘরে কেউ একজন চাপা গলায় বলছে “খবরদার কোনো শব্দ করবে না। একটা শব্দ করলে তোমার মেয়ের মগজ ফুটো করে ফেলব।” তখন হঠাৎ করে ধস্তাধস্তির শব্দ কমে গেল। সেরিনা শুনল তার আব্বু জিজ্ঞেস করছে, “তোমরা কারা? কী চাও?”