গ্রামের সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে সে একটা বড় দিঘীর কাছে পৌঁছাল। দিঘীর পাশে বিশাল একটা গাছ, গাছের শিকড় বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। শামীম গাছের ছায়ায় মোটা একটা শিকড়ের উপর আরাম করে বসে পড়ল। তার পিছনে পিছনে হেঁটে আসা কিশোরী মেয়েটাও কাছাকাছি একটা শিকড়ের ওপর বসে পড়ল। প্রশ্ন করলে মেয়েটি যেহেতু প্রশ্নের উত্তর দেয়
তাই শামীম এবারে আর প্রশ্ন করার চেষ্টা করল না। চোখে চোখ পড়তেই সে একটু হাসার চেষ্টা করল।
মেয়েটা হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কই যান?”
অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না, কারণ সে আসলে কোথাও যাচ্ছে না! মেয়েটা তার প্রশ্নের উত্তরে সন্তুষ্ট হবে না জেনেও শামীম বলল, “আমি কোথাও যাই না।”
“তাহলে এখানে কী করেন?”
“কিছু করি না। বসে আছি।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই শামীমের কথা শুনে মেয়েটা ফিক করে হেসে দিল। মনে হয় একজন বড় মানুষ কিছু না করে শুধু বসে আছে ব্যাপারটা এই মেয়েটার কাছে খুবই হাস্যকর একটা ঘটনা। শামীম অবশ্য এখানে আসার মতো কিছু খুঁজে পেলো না কিন্তু সেও শব্দ করে হাসল। হাসি খুব চমৎকার একটা বিষয়, একটা হাসিতে সব দূরত্ব নিমেষে দূর হয়ে যায়। মূহুর্তে মেয়েটা সহজ হয়ে গেল, সব কিছু বুঝে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গী করে মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি।
“কী বুঝেছ?”
“আপনি পত্রিকার লোক। আমাদের গ্রামের খবর পত্রিকায় লিখবেন।”
মুহম্মদ জাফর ইকবাল শামীম হাসল, বলল, “না, আমি পত্রিকার লোক না! তোমাদের গ্রামে পত্রিকায় লেখার মতো খবর আছে?”
মেয়েটা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “কালাম চাচার গাইয়ের একটা বাছুর হয়েছিল তার দুইটা মাথা।”
শামীম মাথা নাড়ল, “এটা মনে হয় খবরের কাগজে ছাপা হওয়ার মতই খবর।” জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু?”
“মতি চোরা যখন গরু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল তখন তার মাথার চুল কামিয়ে মুখে আলকাতরা মাখিয়ে সারা গ্রামে ঘুরিয়েছে।”
“আর কিছু?”
“স্বামীর সংসারে অশান্তি সেই জন্যে সকিনা খালা গলায় দড়ি দিয়েছিল।”
শামীম একটা নিশ্বাস ফেলল, দেশের আনাচে-কানাচে এরকম কতো দুঃখের কাহিনী না জানি লুকিয়ে আছে। মেয়েটা আংগুলে গুনে গুনে তাদের গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো দিতে থাকে। শামীম অন্যমনস্ক ভাবে শুনতে শুনতে দূরে তাকিয়ে থাকে। বিশাল দিঘীটার এক পাশে কিছু দুরন্ত ছেলে দাপাদাপি করছে। গ্রামের মহিলারা দিঘীতে বাসনপত্র ধুতে এসেছে। কাপড় কাঁচছে। সড়ক দিয়ে রাখালেরা গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বসে থেকে শামীম উঠে দাঁড়াল। মেয়েটাও উঠে দাঁড়াল, জিজ্ঞেস করল, “কই যান।”
“একটু হেঁটে দেখি।”
শামীম সড়কের নরম ধূলায় পা ডুবিয়ে হাঁটতে থাকে, মেয়েটাও তার পাশে পাশে হাঁটে-এবারে আর নিরাপদ দূরত্বে থেকে নয়, পাশাপাশি। মেয়েটা আঙুল দিয়ে দূরে দেখিয়ে বলল, “ঐ দিকে আমার বাড়ি।”
“তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”
“বাবা আছে। ভাই আছে বুবু আছে।”
“মা?”
“মা-ও আছে।” বলে মা থাকার পরও মায়ের কথা না বলার জন্যে মেয়েটা একটু অপরাধীর মতো হাসল। সড়কটা ধীরে ধীরে সরু হয়ে আসে। সড়কের দুই ধারে বড় বড় গাছ সড়কটাকে আবছা অন্ধকারে ঢেকে ফেলে। সড়কের এক পাশে খানিকটা জলা জায়গা, তার কাছাকাটি আসতেই বেশ কয়েকটা ব্যঙ পানিতে লাফিয়ে পড়ল। শামীম একটু চমকে উঠল এবং সেটা দেখে মেয়েটা হি হি করে হাসতে শুরু করল।
দুইজন আরো একটু এগিয়ে যায়, সড়কের এক পাশে একটা ছোট ডোবা এবং সেখানে হঠাৎ কী যেন খল-বল করে ওঠে। এবারে মেয়েটা চমকে উঠল তারপর ডোবার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে বলল, “মাছ!”
শামীম জিজ্ঞেস করল, “কী মাছ?”
“জানি না। বড় মাছ।”
“এই ছোট ডোবাতে বড় মাছ আছে?”
মেয়েটা যুক্তিতর্কের দিকে গেল না, বলল, “বাবারে ডেকে আনি। কোঁচ দিয়ে মাছটারে ধরবে।”
কোঁচ জিনিষটা কী শামীম বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা যাই হোক সেটা দিয়ে, কী ভাবে মাছটাকে ধরবে সেটা দেখার জন্যে শামীমের একটু আগ্রহ হল। সে বলল, “যাও ডেকে আন।”
মেয়েটা বাবাকে ডাকতে ছুটে গেল, শামীম ডোবার পাশে পা ছড়িয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। পানিতে তাকিয়ে বড় মাছটা দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছু চোখে পড়ল না। কিছুক্ষণের মাঝেই মেয়েটা তার বাবাকে ডেকে আনে, বাবা কমবয়সী শক্ত সামর্থ্য একজন মানুষ, তার হাতে একটা কোঁচ এবং সেটা দেখে শামীম চমকে উঠল। কোচ হচ্ছে একটা বর্শা, তবে এই বর্শায় ফলা একটি নয়, অনেকগুলো। এটা দিয়ে একটা মাছকে গেঁথে এফোঁড় ওফোড় করে ফেলবে চিন্তা করেই শামীমের গা গুলিয়ে এল। তারপরেও দৃশ্যটা দেখার জন্যে শামীম দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটার বাবা খুব সাবধানে ডোবার দিকে নেমে যেতে থাকে। মেয়েটি তার বাবাকে জায়গাটা দেখিয়ে দেয় কেমন করে মাছটিকে গেঁথে ফেলা হবে দেখার জন্যে শামীম দাঁড়িয়ে গেল। মানুষটি তীক্ষ্ম চোখে দেখতে দেখতে নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকে তখন হঠাৎ ডোবার কিনারে পানিটা আবার খল-বল করে উঠে। কোঁচ হাতে মানুষটি তার সমস্ত শক্তি দিয়ে মাছটিকে কোচে গেথে ফেলার পূর্ব মুহূর্তে শামীম অমানুষিক গলায় চিৎকার করে উঠল, ”না!”
শেষ মূহূর্তে মানুষটি থেমে অবাক হয়ে শামীমের দিকে তাকাল। পানিতে যেখানে খল-বল করে উঠেছে শামীম সেখানে স্পষ্ট দেখেছে ছোট একটা শিশুর হাত নড়ে উঠেছে। শামীম তীর থেকে ছুটে এসে ডোবার পানিতে নেমে এল, যেখানে পানি খল-বল করছে শামীম সেখানে ছুটে এসে হাত ডুবিয়ে দেয়, তার হাতে জ্যন্ত কিছু নড়ে উঠল, শামীম সেটাকে ধরে উপরে তুলে আনে। সবাই বিস্ফারিত চোখে দেখল, তার হাতে ছোট একটা মানব শিশু, পেট থেকে আমব্লিক্যাল কর্ডটা ঝুলছে।