“যা নেমে যা।”
সেরিনা তখন বিলের পানিতে নেমে গেল। শামীম দেখল আশ্চর্য রকম সাবলীলভাবে তার মেয়েটি পানির গভীরে যেতে থাকে কিছুক্ষণেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়। শামীম একটা নিশ্বাস ফেলল, আজকাল মাঝে মাঝে তার মনে হয় এই মেয়েটি বুঝি ডাঙ্গা থেকে পানিতে বেশি স্বস্তি বোধ করে।
নৌকাটা স্থির রাখার জন্যে একটা লোহার রডকে বাঁকা করে কাজ চালানোর মতো নোঙর তৈরী করে এনেছিল সেটা পানিতে ফেলে দিয়ে শামীম চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। বহুদূরে কয়েকটা জেলে নৌকা, তার চাইতেও দূরে স্পীড বোটটা পানিতে স্থির হয়ে আছে। সেটি কাছে আসছে না আবার চলেও যাচ্ছে না। ঠিক কী কারণ জানা নেই শামীমের মনে হয় বিদেশী লোকটা বাইনোকুলার দিয়ে তাদের দেখছে। এক সময় শামীম নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়ল। মানুষেরা সাধারণ খোলা জায়গায় আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে না, মানুষ ঘরের ভেতর শোয়, তাই তাদের দৃষ্টি বাড়ীর ছাদে আটকে যায়। খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকলে দৃষ্টি কোথাও আটকে যায় না, সেই আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, আকাশে সাদা মেঘ, মেঘের পাশে দুই পাখা বিস্তৃত করে আকাশে ভেসে থাকা চিল দেখা যায়। কী কারণ জানা নেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শামীম কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে যায়।
.
সূর্য পশ্চিম দিকে অনেকখানি হেলে যাবার পর সেরিনা পানি থেকে বের হয়ে এল। তার সারা শরীর পানিতে চিক চিক করছে। কোচড় বোঝাই নানা ধরনের শৈবাল, শামুক, পানির লতাপাতা ফলমূল। নৌকার মাঝে সেগুলো ঢেলে দিয়ে বলল, “আব্বু, তোমার জন্যে এনেছি।”
“আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ আব্বু, খেয়ে দেখো।”
“তোর কবে থেকে ধারণা হলো আমি শামুক খাই, পানির লতাপাতা খাই?”
“তুমি বলছিলে না পানিতে কোনো খাবার নেই, সেই জন্যে এনেছি। ঐ কাঁটা কাটা ফলটা ভেঙ্গে দেখো ভেতরে কী মজার শাঁস। একেবারে গাজরের মতোন।”
“থাক! আমার যখন গাজর খাবার ইচ্ছে করবে তখন কাঁটা কাঁটা আজব কোনো ফল না খেয়ে বাজার থেকে গাজর কিনে আনব!”
“আব্বু তুমি খুবই বোরিং একজন মানুষ।”
“একটা ফেমিলিতে এক্সাইটিং মানুষ বেশী থাকা ভালো না। একজনই যথেষ্ট! এখন বল তুই পানির নিচে কী দেখলি।”
সেরিনার চোখ দুটো হঠাৎ চক চক করতে থাকে। সে দুই হাত নেড়ে বলল, “তুমি বিশ্বাস করবে না আব্বু পানির নিচে কী অসাধারণ সুন্দর। কতো রকম যে মাছ তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। শুধু মাছ না আব্বু আরো কতো রকম প্রাণী যে আছে–
“কতো রকম প্রাণী মানে?”
“সাপের মতন কিন্তু সাপ না। ব্যাঙের মতন কিন্তু ব্যাঙ না। এছাড়াও ভেঁদড় আছে, পানকৌড়িকেও দেখেছি! বড় বড় মাছ ঘুরে বেড়ায় তাদের পিছনে তার লক্ষ লক্ষ পোনা! কী যে মজা লাগে দেখতে! কতো রকম গাছ, গাছের ফাঁকে ফাঁকে কতো রঙিন মাছ! তোমাকে একদিন নিয়ে যেতে হবে।”
“থাক আমাকে নিতে হবে না। তুই গেলেই হবে।”
“আমি আবার যাব আব্বু। আজকে কিছুই দেখা হয় নি।”
“ঠিক আছে আরেকদিন যাবি। আজকে বাসায় চল।”
“চল আব্বু।”
শামীম নোঙরটা তুলে বৈঠা বেয়ে নৌকাটা তীরের দিকে নিতে থাকে। দূরে স্পীড বোটটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। তারা তীরে পৌঁছানোর পর স্পীড বোটটা গর্জন করে আরো দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
.
বাংলা ক্লাশটা হওয়া উচিৎ সবচেয়ে আনন্দের কিন্তু সেরিনার কাছে বাংলা ক্লাশটা অসহ্য মনে হয়। ক্লাশটা পড়ান মকবুল স্যার। এই স্যারের মতো নিরানন্দ মানুষ পৃথিবীতে নাই, কথাবার্তাও বলেন এমনভাবে যে শুনলেই একজন মানুষ নেতিয়ে পড়বে। মকবুল স্যার ক্লাশের মাঝামাঝি গিয়েছেন আর তখন থেকে সেরিনা একটু পরে পরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। তাদের ক্লাশরুমটা দোতলায়, দোতলা থেকে তাকালে বাইরে রাস্তা, রাস্তায় মানুষ, গাড়ী, টেম্পো সবকিছু দেখা যায়। মকবুল স্যারের একঘেয়ে গলার স্বর থেকে টেম্পুর হর্ণের শব্দ অনেক বেশি মজার।
সেরিনা রাস্তার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে হঠাৎ করে মাইক্রোবাসটা সেরিনার চোখে পড়ল। বিয়ের সময় বরযাত্রী নেবার জন্যে যে রকম মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয় এটা মোটেও সেরকম মাইক্রোবাস নয়, মাইক্রোবাসটা খুব চকচকে, খুবই আধুনিক। দেখলেই বোঝা যায় খুব দামী মাইক্রোবাস। তাদের মফস্বল শহরে এরকম গাড়ী কখনো দেখা যায় না।
মাইক্রোবাসটা তার ক্লাশরুমের খুব কাছাকাছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটা ক্লাশরুমের এতো কাছে যে সে মাইক্রোবাসের প্যাসেঞ্জারকেও এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পায়। প্যাসেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল, মানুষটা বিদেশী, চোখে কালো চশমা হাতে একটা বাইনোকুলার। আর কী আশ্চর্য মানুষটা ঠিক তার দিকে তাকিয়েছিল, চোখে চোখ পড়তেই মানুষটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মাত্র সেদিন যখন সেরিনা তার আব্বুকে নিয়ে বিলের ভেতর গিয়েছিল তখন এই মানুষটাই স্পীড বোটে করে তাদের নৌকার চারপাশে ঘুরপাক খেয়েছে। হঠাৎ করে সেরিনার বুকটা ধ্বক করে ওঠে–তাহলে কী এই মানুষগুলো তার জন্যে এসেছে? কোনোভাবে তার খবর জেনে গেছে? সেরিনা এক ধরণের আতংক অনুভব করে। কখন মকবুল স্যারের ক্লাশ শেষ হয়ে গেছে সে টেরও পায় নি।
সেরিনা তার ডেস্ক থেকে তার বই খাতা নিয়ে উঠে গেল, গৌরী ক্লাশের পিছন দিকে বসেছে, তার কাছে গিয়ে বলল, “গৌরী তুই একটা কাজ করবি?”