শামীম বলল, “তোর ধারণা শুধু তুই পানিতে ওঠা-নামা করতে পারিস, আমরা পারি না?”
“তুমি যেরকম জবুথবু তোমাকে দেখে তো সে-রকমই মনে হয়।”
“আমার সাথে ঠাট্টা করবি না, খবরদার।”
“ঠিক আছে তোমার সাথে ঠাট্টা করব না।” সেরিনা এক মুহূর্ত থেমে বলল, “থ্যাংকু আব্বু। তোমাকে অনেক থ্যাংকু।”
“কেন? হঠাৎ করে আমাকে এতো থ্যাংকু কেন?”
“এই যে তুমি আমাকে আজকে এই বিলে নিয়ে এসেছ, সেইজন্যে।”
শামীম বৈঠা দিয়ে পানি কাটতে কাটতে বলল, “কাজটা খুব সহজ হয় নাই। এই নৌকাটা কিনতে হয়েছে, নৌকা চালানো শিখতে হয়েছে।”
সেরিনা আরেকটা বৈঠা হাতে নিয়ে বলল, “ভালোই তো হয়েছে, নৌকা চালানো অনেক ভালো ব্যায়াম। তুমি তো শুধু চেয়ার টেবিলে বসে লেখাপড়া করো। তোমার ব্যায়াম করা দরকার ছিল। আজকে তোমার ব্যায়াম হবে।”
শামীম বলল, “অনেক হয়েছে। এখন মুখটা বন্ধ কর।”
“না, আব্বু, তোমাকে আসলেই থ্যাংকু। আমাদের পুকুরের তলাটা দেখতে দেখতে চোখটা পচে গেছে; ওখানে দেখার মতো কিছুই নাই। এই বিলটার কথা চিন্তা কর–কতো বড় একটা বিল, এইটার পানির নিচে না জানি কতো কি আছে?”
“সেইটা ভালো না খারাপ আমি বুঝতে পারছি না।”
“খারাপ কেন হবে?”
“পানির নিচে কী আছে কে জানে!”
সেরিনা খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল, “আব্বু তুমি পানিকে এতো ভয় পাও কেন?”
“আমি মোটেও পানিকে ভয় পাই না। প্রত্যেকদিন ঘুমানোর আগে আমি দুই গ্লাস পানি খাই!”
“সেটা ঠিক। বোতলের পানিকে তুমি ভয় পাও না। কিন্তু পুকুরের পানি, বিলের পানি, নদীর পানি, সমুদ্রের পানি তুমি ভয় পাও!”
শামীম মাথা নেড়ে বলল, “আমি তো তোর মতো পানির নিচে থাকতে পারি না, দেখতে পারি না–তুই যখন পানির নিচে থাকিস তখন কী করিস আমি দেখতে পারি না তাই তোর জন্য আমার একটু ভয় লাগে।”
সেরিনা গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার জন্যে তুমি একটুও ভয় করো না আব্বু। পানির নিচে কেউ আমাকে কিছু করতে পারবে না।”
“থাক এতো বড় বড় কথা বলে লাভ নেই।”
“সত্যি আব্বু। আমার কী মনে হয় জান?”
“কী মনে হয়।”
“আমি ইচ্ছে করলে পানির নিচে দিনের পর দিন থাকতে পারব।”
শামীম ভুরু কুঁচকে বলল, “কী বললি?”
সেরিনা বলল, “বলেছি যে আমি ইচ্ছে করলে পানির নিচে দিনের পর দিন থাকতে পারব।”
“খাবি কী? ঘুমাবি কোথায়?”
“শুকনো জায়গায় খাওয়ার কিছু নাই আব্বু। পানির নিচে অনেক রকম খাবার। আর ঘুমানোর জন্য পানির নিচে কিছু লাগে না। আমি যে কোনো জায়গায় ঘুমাতে পারি। তুমি তো কখনো পানির ভেতরে ভেসে ভেসে ঘুমাও নি তাই তুমি জানো না পানিতে ঘুমাতে কতো আরাম। একবার পানিতে ঘুমানো অভ্যাস হয়ে গেলে তুমি বিছানায় ঘুমাতেই পারবে না।”
শামীম একটু শংকিত দৃষ্টিতে সেরিনার দিকে তাকিয়ে থাকে একটু পরে বলে, “কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি ভালো না। তোকে পানির নিচে ঘুমাতে হবে না, থাকতেও হবে না। তোর যদি পানির নিচে থাকার কথা হতো তাহলে খোদা তোকে পাঙাস মাছ করে পাঠাতো। খোদা মোটেই তোকে পাঙ্গাস মাছ করে পাঠায় নাই। তোকে সেরিনা করে পাঠিয়েছে।”
সেরিনা খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল, “আব্বু তুমি এতো মজা করে কথা বলতে পার! পাঙ্গাস। হি হি হি!”
শামীম চারদিকে তাকায়। আশেপাশে এখন কোনো জেলে নৌকা নেই। সেরিনা যখন পানিতে নামবে শামীম চায় না তখন কেউ সেটা দেখুক। গোপনে কয়েক ঘণ্টা পানির নিচে ভেসে বেড়িয়ে আবার বের হয়ে আসবে। শামীম বলল, “সেরিনা জায়গাটা কেমন? এখানে নামবি?”
সেরিনা বলল, “ফ্যান্টাস্টিক। পানি কতো পরিষ্কার দেখেছ? এখানে অনেক দূর পর্যন্ত আলো যাবে। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাবে।”
সেরিনা ঠিক যখন বিলের পানিতে নেমে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ দূর থেকে একটা শক্তিশালী ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল, শামীম একটু অবাক হয়ে তাকাল, দেখল বহুদূর থেকে একটা স্পীডবোট ছুটে আসছে। শামীম বলল, “এই বিলে স্পীডবোট কোথা থেকে আসছে?”
“জানি না, আব্বু।”
সেরিনাও দূরে তাকিয়ে থাকে। স্পীড বোটটা গর্জন করে পানি কেটে তাদের দিকে আসছে। দেখতে দেখতে সেটা কাছে চলে আসে, তাদের নৌকাটার খুব কাছে দিয়ে সেটা ছুটে চলে যায়। স্পীডবোটের তৈরি ঢেউয়ে শামীম আর সেরিনার নৌকাটা বেশ ভালো রকম দুলতে থাকে।
স্পীড বোটে কয়েকজন মানুষ বসে আছে, এর মাঝে একজনকে বিদেশী মনে হলো। চোখে কালো চশমা, রঙিন সার্ট। হাতে বাইনোকুলার। শামীম বলল, “নিশ্চয়ই এনজিও।”
“কিসের এনজিও আব্বু।”
“জানি না। বিদেশী এনজিওগুলো পকেটে করে কিছু ডলার এনে ছিটিয়ে দেয় আর সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।”
সেরিনা বলল, “এখন নামি আব্বু?”
“একটু দাঁড়া। স্পীড বোটটা একেবারে চলে যাক।”
কিন্তু স্পীড বোটটা একেবারে চলে গেল না, বেশ কিছুদূর গিয়ে আবার সেটা ঘুরে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, দেখে মনে হয় সোজা তাদের দিকে আসছে, কাছাকাছি এসে স্পীড বোটটা একটু সরে গিয়ে প্রায় তাদের নৌকায় পানি ছিটিয়ে বের হয়ে গেল। শামীম বলল, “কেমন বেয়াদপের মতো স্পীডবোট চালাচ্ছে দেখেছিস?”
“হ্যাঁ। দেখেছি।” স্পীড বোটে বসে থাকা মানুষটা যে বাইনোকুলার চোখে তাদের অনেক দূর থেকে লক্ষ্য করেছে সেটাও সে দেখেছে। কিন্তু শামীমকে কিছু বলল না।
“এবারে আমি নেমে যাই আব্বু?”